ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি রাজি হয়েছিলেন আমানপুরকে সাক্ষাৎকার দেবেন। শর্ত দিয়েছিলেন, সে জন্য আমানপুরকে হিজাব পরতে হবে। উল্লেখ্য, সেই সময় রাইসি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম সভায় যোগ দিতে নিউইয়র্কে ছিলেন।
আমার মতে, ক্রিস্টিয়েন আমানপুরের উচিত ছিল হিজাব পরার শর্ত মেনেই ইব্রাহিম রাইসির সাক্ষাৎকার নেওয়া। সিএনএনের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তাঁর একক সিদ্ধান্তে হলেও।
ধারণা করি, আমানপুরকে হিজাব পরতে বলা ছিল ফাঁদ। রাইসি জানতেন, আমানপুর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ছিঁড়েখুঁড়ে তাঁর মুখ দিয়েই বের করে আনবেন ইরানের যাবতীয় দুর্বলতা, নারীর প্রতি অন্যায় ও অবিচারের ইতিবৃত্ত। জানতেন, সাক্ষাৎকারটি দুনিয়াময় ভাইরাল হবে। সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিস্টিয়েন আমানপুর রাষ্ট্রপ্রধানদের তুলাধোনা করে ফেলতে পারার জন্য জগদ্বিখ্যাত।
তাঁর সাক্ষাৎকারপূর্ব হোমওয়ার্কের ধরন-ধারণ আগে থেকে ধরতে পারা কঠিন। কোন দিক থেকে আক্রমণ হানবেন, শুধু তিনিই জানেন। তাই রাইসি মোক্ষম চাল চাললেন। হিজাব। এক ঢিলে বহু পাখি মারার ফন্দি। জানতেন আমানপুর হিজাব পরবেন না। তাঁকেও সাক্ষাৎকার বাতিলের জন্য গ্রহণযোগ্য ছুতো খুঁজতে হবে না। সমালোচিতও হতে হবে না।
অথচ আমানপুরকে ইব্রাহিম রাইসির সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হওয়া ছিল চাঁদ হাতে পাওয়া। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক কোটি শেয়ার হতো নিশ্চিত। সারা দুনিয়া জানতে পারত সত্য-মিথ্যা। আমানপুরও জটিল পরীক্ষায় পড়েছিলেন সন্দেহ নেই। এ যে এক কঠিন দাবার চাল। ডিলেমাটি সিএনএর জন্যও খুবই কঠিন ছিল সম্ভবত। আমানপুর হিজাব পরলে কী কী সমস্যা হতো, ভেবে দেখা যাক।
এক. হিজাব পরলে মনে হতো আমানপুর মোল্লাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। দুই. দর্শকদের মনে হতো ইরানের নারীদের প্রতি সংহতির বদলে আমানপুর উল্টো আন্দোলনবিরোধী প্রতীকী কাজ করে বসেছেন। তাঁর হিজাব পরিধান আন্দোলনকারীদের নৈতিক মনোবলও ভেঙে দিতে পারত। তিন. তিনি নিজে যে আদর্শিক ধ্যানধারণা-বিশ্বাসের চরম বিরোধী, সেই আদর্শিকতাকে অবমাননা-অপমান করেছেন মনে হতো।
রাজনীতি এবং আদর্শিক ধ্যানধারণা-বিশ্বাসের চাপে বিশ্বসেরা চৌকস সাংবাদিকদের সিদ্ধান্তও অনেক সময় সুচিন্তিত হয় না। আদর্শিক অবস্থান খুবই দরকার, কিন্তু আমানপুর ধ্যানধারণার ফাঁদে আটকে না থেকে রাইসির সাক্ষাৎকার নিলে ইরানে নারীদের আন্দোলনটিই উপকৃত হতো।
আশঙ্কাগুলো একেবারে অমূলকও নয়। হুট করে তাঁর হিজাব পরা দৃষ্টিকটু লাগত। সাক্ষাৎকারটি হতো লাইভ। বিশ্বময় দর্শকেরা উসখুস করতেন। হয়তো মুহূর্তেই অস্থির হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমানপুরকে ধুয়ে দেওয়াও শুরু করতেন। নারীবাদী, হিজাববিরোধী এবং ইসলামবিরোধীরা অপেক্ষা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ত শব্দ-বাক্যের মিসাইল ছোড়াছুড়িতে।
আন্দোলন শুরু হতো আমানপুরকে প্রত্যাহার ও চাকরিচ্যুত করার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যথেষ্টই শক্তিশালী। তবে অনেক সময়ই মাধ্যমটি দায়দায়িত্বহীন ঝুঁকিপূর্ণ, পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক। ফলে এসব আশঙ্কা আমলে না নিইয়েই–বা উপায় কী? এ যে শেক্সপিয়ারের ‘টু বি অর নট টু বি’র দ্বন্দ্ব।
আসলে মাত্র ৫০ মিনিট হিজাব পরা যে আমানপুরের একটি কৌশলমাত্র—সেটি ১ মিনিটেই দর্শকদের বুঝিয়ে দেওয়া যেত। প্রথম প্রশ্নটিই শুরু হতে পারত হিজাব বিষয়ে, যাতে দর্শকের উসখুস কেটে যেত মুহূর্তেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত নানা রকম ধ্যানধারণা-আদর্শিকতায় তাড়িতরা হাত গুটিয়ে নিত। রাইসি একবার বসে গেলে কোনোভাবেই উঠতে পারতেন না।
রাগ, উষ্মা, ক্ষোভ বা বিরক্তি দেখিয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলে সারা দুনিয়া উল্টো তাঁরই সমালোচনায় মুখর হতো। একেবারে উপসংহারে আমানপুরও বলতে পারতেন, ‘আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ভিনদেশের নাগরিক হয়েও আমি হিজাব নিয়েছি নিতান্ত নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে, বিশ্বাসের বা ভক্তির জায়গা থেকে নয়। তাহলে আপনার দেশের নাগরিক নারীরা কড়া আইনের অধীন কতটা বীতশ্রদ্ধ, নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে হিজাব পরেন—কখনো ভেবে দেখেছেন কি জনাব প্রেসিডেন্ট?’
আমানপুর বিশ্বসেরা ঝানু সাংবাদিক। তাঁকে জ্ঞান দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখানো এই কলামের উদ্দেশ্য মোটেই নয়। তবে সাংস্কৃতিক রাজনীতির নৃতত্ত্ব পাঠে আগ্রহী যে কেউই পেছনের রাজনীতিগুলোও ধরে ফেলতে পারবেন। অনুষ্ঠানটি বাতিলের প্রতিক্রিয়াগুলোর দিকে নজর দিলে পরিস্থিতি বুঝতে পারা সহজ। রাইসির অনুষ্ঠান বাতিলকে উপজীব্য করে ইসলামবিরোধিতা এবং হিজাববিরোধিতার ঝড় তুলেছে পশ্চিমারা।
ফ্রান্সে, কানাডায়, সুইডেনে, বেলজিয়ামে, নেদারল্যান্ডসে একদল উসকে দিচ্ছে কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করার বিষয়টি। স্থানীয় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপচে পড়ছে ইসলাম যে কত খারাপ, সেই আলোচনায়। অথচ আলোচনা হওয়ার কথা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র, স্বৈরাচার এবং একনায়কত্ব হটানোর কৌশল নিয়ে। সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রশক্তি ইরানে নারীদের আন্দোলন দমিয়ে ফেলতে পারে এই সুযোগে। তাতে বিপদ বাড়বে নারীদেরই। হাজারো নারী বন্দিত্ব, নিগ্রহ, রাষ্ট্রীয় খুন এবং আরও কঠিন অবদমনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে পারেন।
বাংলাদেশেও অনেকে নিতান্তই না বুঝে পশ্চিমা বয়ানের এবং কূটচালের পালে বিপজ্জনক হাওয়া দিয়ে চলেছেন। শুধু একটি উদাহরণ দিই। আলোচনায় উঠে আসছে যে দুই বছর আগে তালেবান প্রতিনিধি নারী সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনার সময় ‘আই কন্ট্যাক্ট’ বা চোখে চোখ রাখেননি। রাইসি সাক্ষাৎকারে বসলেও চোখে রাখতেন না। ‘চোখে চোখ’ রেখে কথা বলতে না পারা ইসলামি কট্টরপন্থার ফল—এমন ধারণা একটি নিরেট পশ্চিমা বয়ান।
এশিয়ার অন্তত ১০টি দেশ আছে, যেগুলোতে অন্যদের চোখে চোখ রাখাকে অভদ্রতা গণ্য করা হয়। চর্চাটি অনেক ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক বা কৃষ্টিগত। অস্ট্রেলিয়ায় চোখে চোখ রেখে কথা না বলা অভদ্রতা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অনেকগুলো আদিবাসী গোষ্ঠীতে চোখে চোখ রাখা অশালীন আচরণ বিবেচিত হয়। জাপান, চীন, মঙ্গোলিয়া ও থাইল্যান্ডেও চোখ নামিয়ে কথা বলাকে ভদ্র, সভ্য ও কাম্য আচরণ মনে করা হয়।
‘দৃষ্টি আনত রেখো’ প্রাচ্যের একাধিক ধর্মীয় সংস্কৃতিরও অনুষঙ্গ। আফগানিস্তান ও ইরানে অনাত্মীয় নারীদের চোখে পুরুষের সরাসরি চোখ না রাখাও স্থানীয় সাংস্কৃতিক আচরণ ও চর্চার অংশ। পাশ্চাত্যের আমজনতা প্রাচ্যে বিরাজমান সাংস্কৃতিক ভিন্নতাগুলো না-ও জানতে পারে।
তাদের টুইটার-ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম বয়ানকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে হিজাব-বিদ্বেষ ও ইসলাম-ঘৃণা শেয়ার করা বাড়তে থাকলে ইরানের নারীদের ন্যায্য দাবি ও পরিবর্তনের আন্দোলনই উপেক্ষিত হয়। মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি সরে যাওয়া খারাপ লক্ষণ। হিজাব-কৌশলে আমানপুর সাক্ষাৎকারটি নিতে পারলে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরত না।
রাজনীতি এবং আদর্শিক ধ্যানধারণা-বিশ্বাসের চাপে বিশ্বসেরা চৌকস সাংবাদিকদের সিদ্ধান্তও অনেক সময় সুচিন্তিত হয় না। আদর্শিক অবস্থান খুবই দরকার, কিন্তু আমানপুর ধ্যানধারণার ফাঁদে আটকে না থেকে রাইসির সাক্ষাৎকার নিলে ইরানে নারীদের আন্দোলনটিই উপকৃত হতো।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়