শ্বেতপত্রে আমরা জানাতে চেয়েছি, অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে কেমন অর্থনীতি পেয়েছে এবং যে অবস্থায় পেয়েছে, তার কাহিনি কী। এই বিস্তৃত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা বিভিন্ন পেশাগত গোষ্ঠীর মতামত এবং ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে ডেটা বিবেচনা করে একটি সারগ্রাহী পদ্ধতি অনুসরণ করেছি।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের দক্ষ নেতৃত্বে কমিটি নির্বিঘ্নে নির্মোহ কাজ করেছে। সরকারের কোনো অংশ বা স্তরের হস্তক্ষেপ ছিল না। আমরা যা অনুভব করেছি, যুক্তিযুক্ত এবং যথাসম্ভব প্রমাণিত, তা বলতে পেরেছি। ব্যক্তিগতভাবে এটি ছিল আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উপভোগ্য কাজ।
সংক্ষেপে, অন্তর্বর্তী সরকার লন্ডভন্ড অর্থনীতি পেয়েছে। বিকৃত তথ্য, মধ্য আয়ের ফাঁদ, বৈষম্যের আধিক্য, সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা, ব্যবস্থাপনার অযোগ্যতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈন্য। কীভাবে এই হযবরল-এর বিবর্তন ঘটল, তা বুঝতে বড় অন্তরায় তথ্যের বিশ্বাসহীনতা, যা কিনা পরিসংখ্যানকে রাজনৈতিক প্রচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কারণে ঘটেছে। প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি, রিজার্ভ, রাজস্ব, প্রকল্প খরচ, খেলাপি ঋণ, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচক সুবিধামতো মালিশ করা হয়েছে।
দূষণের খোলসমুক্ত তথ্য বলে, আমাদের অর্থনীতি নিম্ন মধ্য আয়ের বৃত্তে আটকে আছে কোভিডের বেশ কিছু বছর আগে থেকে। এটি বিভিন্ন কাঠামোগত সূচক থেকে স্পষ্ট—যেমন রপ্তানির বৈচিত্র্য ও গভীরতা, বিনিয়োগের মান ও তীব্রতা, আর্থিক খাতের বিশ্বাস ও সচ্ছলতা বা তরুণদের উপার্জনের সুযোগ ও সমৃদ্ধিশীলতা।
দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং একটি পরিসংখ্যানগত বিভ্রম। সরকারিভাবে রিপোর্ট করা জিডিপি বৃদ্ধির হার ইচ্ছাকৃতভাবে স্ফীত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, তারা ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া প্রবৃদ্ধির হ্রাস ধরতে পারেনি।
ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির আখ্যান উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে বড় ক্ষতি করেছে। যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা প্রশ্ন ছাড়াই করতালি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছেন যে তাঁরা সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবহার করতে বাধ্য, যখন সরকার এটিকে প্রত্যয়িত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। এটি সরকারি পরিসংখ্যানকে এমন বৈধতা দিয়েছে, যা কখনোই প্রাপ্য ছিল না।
এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন মডেল হিসেবে ট্যাগ করতে থাকে। রান্না করা পরিসংখ্যানে পূর্ণ উন্নয়নের মিথ্যা আখ্যান আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা খেয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাদের বয়ান প্রমাণ করার জন্য প্রতিটি সুযোগে এই প্রশংসাগুলো ব্যবহার করেছে।
যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, তা পূরণের জন্য আমাদের সবাইকে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সার্বভৌমত্ব, বাক্স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তি—এই বছরের বিজয় দিবসে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার হতে হবে।
হয়তো এই কারণেই আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি বিভাজনের আধিক্যের সমাজে। ভোগ, আয়, সম্পদ, সুযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, জেন্ডার—সব ক্ষেত্রেই। অনেকের সামাজিক গতিশীলতা এখনো জন্মের সময় ভাগ্যের ওপর পুরোটাই নির্ভরশীল। দারিদ্র্যসীমা উতরে গেলেও সেটিকে অতীতে পরিণত করার সংখ্যা দৃশ্যমান হতে পারেনি।
আজ ওপরে তো কাল নিচে, নিয়তি যদি সহায়ক না হয়। উন্নয়নের তথাকথিত জোয়ার প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে আগামীর সম্ভাবনাকে ডুবিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বিনিয়োগের খরা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের অপচয় করেছে। সুবিধাভোগী নেতা-নেত্রীরা অলিগার্কদের সহযোগিতায় অসাধু পথে অর্জিত বিশাল পুঁজি বিদেশে জমিয়েছেন।
বেশ কিছু বিষফোড়া অর্থনীতির প্রতিরোধশক্তি হ্রাস করেছে। এর পেছনে আন্তর্জাতিক কারণ থাকলেও সেটার ব্যবস্থাপনায় আমাদের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণ মানুষকে জীবিকার সংকটে রেখেছে। জ্বালানি খাত অতিরিক্ত মূল্যের চুক্তিতে নিমজ্জিত এবং ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দ্বারা দুর্দশাগ্রস্ত। দুর্নীতি এই দুটিকে বাঁধা সুতো।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস চুক্তি এমন ‘চাবি মাইরা ছাড়ল’, যাতে ‘বিলের ঘড়ি’ বছরের পর বছর চলতেই থাকে। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে স্বজনদের পরের ধনে পোদ্দারিই শুধু নয়, লুটে নেওয়ার পথ ও মসৃণ করা হলো। সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে রক্ষাকবচ ভেঙে পড়ল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধসে পড়েছে। সংকটের সুযোগ নিয়ে মুদ্রাবাজার দখল করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে এবং প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ করেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা গর্তে ডুবেছে। ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনের চেয়ে ক্রনিজম থেকে বেশি লাভ হয়েছে।
প্রবৃদ্ধির নামে প্রবৃদ্ধিবিরোধী নীতির প্রসার ঘটেছে।সরকারি অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে। অনেক মোটা অঙ্কের ঋণ থেকে অর্থের মূল্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঋণের ওপর সুদ ও পরিশোধ জমতে থাকে। শাসকশ্রেণি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ঋণের অন্যায় বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
আত্মতুষ্টি তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। সমস্যার স্বীকৃতি মেলেনি, সমাধানের সুযোগ পায়নি। আমাদের নিয়ম, নীতি ও বিভিন্ন অঙ্গনে স্থানীয় এবং জাতীয় সংগঠনগুলো তছনছ হয়ে গেছে। দুর্নীতির দুষ্টচক্র সব স্তরে গেঁড়ে বসেছে, রাজকোষে পুরোপুরি জমা হয়নি করদাতার টাকা, উন্নয়নের নামে ভ্যানিটি প্রকল্প অগ্রাধিকার পেয়েছে, অনিয়ম নিয়ম হয়েছে, অযোগ্য মেধাকে হারিয়েছে, শর্ষের ভেতরে ভূতের রাজ চলেছে।
এ অবস্থায় সরকার চালানোর গুরুদায়িত্ব গ্রহণের জন্য শুধু ধন্যবাদ দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অবিচার হবে। কারণ, সমবেদনার পাল্লাটা বেশি ভারী। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, তা পূরণের জন্য আমাদের সবাইকে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সার্বভৌমত্ব, বাক্স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তি—এই বছরের বিজয় দিবসে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার হতে হবে।
● জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ