ইরানের নির্বাচনে অতিরক্ষণশীল অভিভাবক পরিষদের কঠোর তদারকি সব সময়ই থাকে। সব ধরনের নির্বাচনেই তাদের নিজস্ব পছন্দের প্রার্থী থাকেন। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগপর্যন্ত দেখা গেছে, মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থীরা পার্লামেন্টে কমবেশি প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন।
কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রাথমিক স্তরে এবং এমনকি দ্বিতীয় স্তরে মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করা করা হয়। ফলে অনিবার্যভাবে ভোটারদের একটা বড় অংশ, যাঁরা আশা করেন ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব, তাঁরা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পড়ে। ১৯৭৯ সালে ইরান প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর সবচেয়ে কম ভোট পড়ে সেই নির্বাচনে। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান রক্ষণশীলেরা।
নির্বাচনের এই ফলাফল নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছিলেন, ‘বদ্ধমূল প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে যথেষ্টসংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছেন।’
চরমপন্থী অংশের সমর্থনে পরিচালিত ওয়েবসাইটগুলোতে প্রতিদিন সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির মধ্যপন্থী সরকারকে সমালোচনা করা হতো। পরমাণু চুক্তির ব্যর্থতার জন্য রুহানি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করেছে, এই বলে তারা সমালোচনা করত। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিল। এই সংবাদমাধ্যমগুলো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলত, ‘সরকারকে ঐক্যবদ্ধ’ করার একটা পরিকল্পনা চলছে।
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামেনি সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার পর থেকে ২০২১ সালে ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগপর্যন্ত ইরানের কোনো প্রেসিডেন্টই পুরোপুরি খামেনির অনুগত ছিলেন না। সরকারকে ঐক্যবদ্ধ করার কৌশলের অংশ হিসেবে মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী প্রধান নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে অভিভাবক কাউন্সিল। ফলে রাইসি নির্বাচনে জেতেন। রাইসি ছিলেন ইরানের ডিপ স্টেটের পছন্দের প্রার্থী।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণের হার ছিল ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সর্বনিম্ন।
ক্ষয়ের বৃত্ত বড় হচ্ছে
ভোটের এই নিম্নহারের প্রবণতা এ বছর মার্চ মাসে প্রথম দফা পার্লামেন্ট নির্বাচনেও অব্যাহত ছিল। মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার এতে ভোট দেন। ইরানের রাজনীতির উপকেন্দ্র তেহরানে ভোটার উপস্থিতির হার ২৪ শতাংশে নেমে আসে।
এ মাসে হয়ে যাওয়া দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়। তেহরানে উপযুক্ত ভোটারদের মাত্র ৭ শতাংশ ভোট দেন। মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তেহরান থেকে শীর্ষ প্রার্থী পার্লামেন্টে তাঁর সদস্যপদ নিশ্চিত করেন।
এই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বিপজ্জনক মাত্রায় কমে যাওয়ার ঘটনাটি কি ইরানের ডিপ স্টেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়? মার্চের নির্বাচন নিয়ে খামেনির মন্তব্য ছিল, ‘শত্রুরা চায়, ইরানে যেন একটা ম্যাড়মেড়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।...আমাদের প্রধান লক্ষ্য একটা সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ উৎসবমুখর নির্বাচন।’
ইরানের ডিপ স্টেটের কাছে নির্বাচন হলো, আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের বৈধতা প্রমাণের উপায়। কিন্তু ভোটার অংশগ্রহণের নাটকীয় হ্রাস সেই উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের এই অনীহার আরেকটি ভিন্ন পটভূমিও রয়েছে। সেটা হলো দৈনন্দিন নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ তীব্র হচ্ছে। অসন্তোষের এই পরিবেশ যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সংস্কার আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মদ খাতামির অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত বেশ বড় রকমের বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। খাতামি এমন একজন নেতা, যিনি সব সময়ই ভোটের মাধ্যমে সংস্কার আনার পক্ষে ওকালতি করে আসছেন। কিন্তু এখন তিনি নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থাকার কথা বলছেন।
ব্যর্থ কৌশল
এই পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় আছে, যেটা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।
ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যাঁরা অংশগ্রহণ করতে চান, তাঁদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ১১ জুন। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৮ জুন।
সম্ভাব্য সেই দুটি ঘটনা কী হতে পারে, তার আগে বলে নেওয়া দরকার যে ইরানের ঐক্যবদ্ধ সরকারের কৌশলটি ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে রক্ষণশীল আন্দোলনের দুটি উপদলের মধ্যে সংঘাত তীব্র আকার নিয়েছে। বিপ্লবী ও অতিবিপ্লবী উপদল দুটি নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দয়ভাবে লড়াইয়ে নেমেছে। উত্তেজনা এতটা তীব্র আকার ধারণ করেছে যে দুটি পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের দুর্নীতি ফাঁস করছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ইরানের ক্ষমতার মূল কেন্দ্রের (খামেনি ও রেভল্যুশনারি গার্ডসের শীর্ষ নেতৃত্ব) সামনে যে মৌলিক প্রশ্নটি এসে হাজির হয়েছে সেটা হলো, নির্বাচনগুলোতে ভোটারের অংশগ্রহণ যেভাবে বিপজ্জনকভাবে কমে যাচ্ছে, তাতে ঝাড়বংশে মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী সব প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করা কতটা বিচক্ষণ?
এই বাস্তবতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম যে ঘটনাটি ঘটতে পারে তা হলো, ইরানের ডিপ স্টেট মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী সবাইকে অযোগ্য ঘোষণা করার নীতি থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সব মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী প্রার্থীর সামনে সুযোগের দুয়ার খুলে যাচ্ছে। এই অংশের মধ্যে কাউকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে গেলে তাঁর প্রথম যোগ্যতা হতে হবে খামেনির কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা।
আলী লারিজানির পক্ষে সেই শর্ত পূরণ করা সম্ভব। লারিজানি একজন মধ্যপন্থী রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি কখনোই মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থীদের স্রোতে গা ভাসাননি।
২০০৮-২০ সাল পর্যন্ত এই ১২ বছর পার্লামেন্টে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন লারিজানি। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভিভাবক পরিষদ তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে। রাইসিকে প্রেসিডেন্ট করার জন্যই লারিজানির প্রার্থিতাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল।
এ ঘটনার পর খামেনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যাঁদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের কারও কারও ক্ষেত্রে অন্যায় করা হয়েছে।’ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, লারিজানির প্রসঙ্গে খামেনি এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। লারজানি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তার কারণ হলো, তিনি খামেনির একজন উপদেষ্টা। এর মানে হচ্ছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে নৈকট্য রয়েছে তাঁর।
আন্তদলীয় প্রতিযোগিতা
লারজানি ছাড়াও সংস্কারপন্থী ও মধ্যপন্থীদের সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন, বর্তমান এমপি মাসউদ পেজেসিকিয়ান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জাহোর্মি, সাবেক এমপি মাজিদ আনসারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান আবদুল নাসের হিমাত্তি।
সে ক্ষেত্রে আগে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের সমাধান হতে হবে। লারিজানি অথবা অন্য যাঁদের নাম উল্লেখ করা হলো, তাঁরা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী? তাঁরা যদি আগ্রহী হন, তাহলে কি অভিভাবক পরিষদ তাঁদের প্রার্থী হিসেবে অনুমোদন দেবে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি জনগণের বিশাল যে অংশ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারা কি ভোট দিতে আগ্রহী হবে?
একটা বিষয় হচ্ছে, ইরানের ডিপ স্টেট তাদের ঐক্যবদ্ধ সরকারের নীতি অব্যাহত রাখে, তাহলে রক্ষণশীল শিবিরের উপদল দুটির মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা হবে।
সে ক্ষেত্রে ইরানের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার, স্পিকার মোহাম্মদ বাকের গালিবাফ, পারভেজ ফাত্তাহ, ইরানের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কৌশলগত পরিষদের সদস্য ও কট্টরপন্থী নেতা সাইদ জালিলি এবং স্বঘোষিত বিপ্লবী ও বর্তমান নগর উন্নয়নমন্ত্রী মেহেরদাদ বজরপাশ।
রাইসির মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা মোখবার ১৫ বছর ধরে ইরানের অন্যতম বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এক্সিকিউটিভ হেডকোয়ার্টার্স অব দ্য ইমাম ডিরেক্টিভ দেখভাল করে আসছেন। প্রতিষ্ঠানটি কেবল খামেনির কাছে জবাবদিহি করে।
গালিবাফ এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সাড়ে ৪ লাখ ভোট পেয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১২ লাখ। এবারে রক্ষণশীল শিবিরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন।
অসমর্থিত সূত্রের খবর বলছে, গালিবাফ নতুন পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি তাঁর সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন।
যাহোক, অভিভাবক পরিষদ থেকে ১১ জুন যোগ্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিপ্লবী ও অতিবিপ্লবী উপদল দুটির মধ্যে তীব্র আন্তদলীয় কোন্দলই আমরা দেখতে পাব বলে মনে হচ্ছে।
বদলে যেতে পারে সমীকরণ
যাহোক, ওপরের সব সমীকরণ বদলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এমনটাও হতে পারে আলী রেজা আরাফি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আলী রেজা ইরানের সব ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনোনয়নের জন্য ৮৮ সদস্যের যে অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্ট রয়েছে, তার সদস্য তিনি।
এ মাসের শুরুর দিকে আমি একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম, খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে রাইসি ও আরাফি প্রধান দুই প্রার্থী।
২৪ মে খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ধর্মীয় কয়েকটি সংগঠন আরাফিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়েছে। যদিও আরাফি সেই অনুরোধ একটিমাত্র শব্দ, ‘না’ বলে খারিজ করে দিয়েছেন।
তারপরও পুনর্বিবেচনা করার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেটা যদি ঘটে, তাহলে রক্ষণশীল প্রার্থীরা তাঁদের নাম প্রত্যাহার করে নেবেন। আর মধ্যপন্থী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। ২০২১ সালে রাইসির বিজয় একইভাবে নিশ্চিত করেছিল অভিভাবক পরিষদ।
শাহির শাহিদসালেস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে