অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের দায়ে পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করছে আওয়ামী লীগ সরকার। দলের নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো সরকার উচ্চপদে আসীন ব্যক্তি কিংবা দলের এমপি–মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার নিয়েছে। খুবই ভালো কথা।
প্রশ্ন হলো এটা সত্যি সত্যি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শুদ্ধি অভিযানের অংশ, না লোক দেখানো পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে নানা চাপে থাকা সরকার বহির্বিশ্বকে দেখাতে চাইছে, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে আছে। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময়ও সরকারের মন্ত্রী–নেতারা এ ধরনেরও কথাবার্তা বলেছিলেন। পরে দেখা গেল, সেটা সত্যিকার অভিযান ছিল না। দুই একজন ব্যতিক্রম বাদে কেউ শাস্তি পাননি।
সাম্প্রতিককালে বেনজীরের পাশাপাশি যাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়, তাঁরা হলেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, কলকাতায় খুন হওয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এর বাইরে মধ্যম পর্যায়ের কিছু সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
সরকার যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগের কথা বলছে, তখন দেশের বাস্তব অবস্থাটা কী। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এর আগে প্রথম আলোতে খবর বের হয়েছিল, এনএসআই কর্মকর্তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবেই শতকোটি টাকার লেনদেন হয়। এই কর্মকর্তার নাম আকরাম হোসেন। দুদকের অনুসন্ধানে এসেছে, তাঁর ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে।
যে কজন ধরা পড়েছেন বা যাদের নামে মামলা হয়েছে, শুধু তাঁরাই কি দুর্নীতি করেছেন? পিকে হালদার কয়েক হাজার কোটি নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরই আমরা জানতে পারলাম তাঁর দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। গুলশান থানার এস আই সোহেল রানার ওপরও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় তাঁর দেশ ত্যাগের পর। ভারতের আদালতে তাঁদের দুজনের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার বার বার ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েও ফেরত আনতে পারছে না।
পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটেছে? কেউ বলছেন তিনি দেশেই আছেন, কেউ বলছেন দেশের বাইরে চলে গেছেন। বৃহস্পতিবার সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয় ‘তিনি দেশে আছেন কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
বেনজিরের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ সম্পদ দখল করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে, তা আলাদীনের চেরাগ না হলে কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের বিশাল এলাকা নিয়ে সাভানা ন্যাচারাল পার্ক তৈরির জন্য শত শত একর জমি কিনেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সেসব জমি কেনা হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিবার নিয়ে বেনজীর দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।’ শুক্রবার আজকের পত্রিকা বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিন মেয়ে, স্ত্রীসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি। স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসার কারণে তাঁরা সে দেশেই অবস্থান করছেন।
৩১ মে প্রথম আলোর অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয়: দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় থাকা সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু আদালতের আদেশ আসার আগেই গত ৪ মে বেনজীর দেশ ছেড়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছেন।
এদিকে দুদক সম্পদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ জুন বেনজীর আহমেদকে এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মির্জাসহ সন্তানদের দুদক তলব করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পদ রয়েছে-এমন খবরে বিষয়টি অনুসন্ধান করছে তারা।
বেনজীর পরিবারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। বেনজির যদি দেশেই না থাকেন, দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে লাভ কী হবে? দেশ ত্যাগের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কার্যালয়ে তাঁকে তলব করেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে এসে দুদক কার্যালয়ে এসে জবানবন্দী দেবেন, এটা কেউ বিশ্বাস করে না। দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ছে অনেক দিন ধরে। সরকার চাইলে আগেই তার বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারত।
সাবেক পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির দায় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক চলছে। আওয়ামী লীগ বলছে, এটা ব্যক্তির দায়। সরকার এর দায় নেবে না। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, সরকার এই দুর্নীতিবাজদের তৈরি করেছে। অতএব, এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। সাংবাদিক কামাল আহমেদ ৩০ মে প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘উচ্চপদে দুর্নীতির জন্য সরকার বিব্রত হয় গণতন্ত্র থাকলে।’
কেউ দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাঁর মূল দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরই। কিন্তু দেখার বিষয়, যখন এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তখন তাঁর অবস্থান কী ছিল? তিনি রাষ্ট্রীয় পদে থেকে এসব কাজ করলে সরকারকেও দায় নিতে হবে।
একটি বাহিনীর শীর্ষ পদাধিকারীর এত অন্যায় যদি সরকারের অজ্ঞাতে হয়ে থাকে, মনে করব সংশ্লিষ্টরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আর সরকার যদি জেনে থাকে ওই ব্যক্তি ক্ষমতাকাঠামো ব্যবহার‘ করে অনধিকার চর্চা করেছেন, তাহলে তখনই তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিল না কেন? অনেকের অভিযোগ, বেনজির দেশত্যাগ করার পরই সরকারের সংস্থাগুলো নড়চড়ে বসেছে।
বেনজিরের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ সম্পদ দখল করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে, তা আলাদীনের চেরাগ না হলে কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের বিশাল এলাকা নিয়ে সাভানা ন্যাচারাল পার্ক তৈরির জন্য শত শত একর জমি কিনেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সেসব জমি কেনা হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি।
বেনজির ও আজিজ আহমেদের কাণ্ড নিয়ে যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়, তখন আপিল বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বৃহস্পতিবার বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি আমাদের সব অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা–কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি এমনকি শত শত কোটি টাকার মালিক হন, তা দেশবাসীকে অবাক করে।’
কিন্তু ক্ষমতাসীনদের অবাক করে না। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনাও লক্ষ্য করা যায় না। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলে আসছে। কিন্তু ক্যাসিনো কাণ্ড, বেনজির আহমদ, পিকে হালদার, সোহেল রানার ঘটনা কিংবা ফরিদপুরে দু্ই ভাইয়ের যোগসাজশে ২ হাজার কোটি টাকা পাচার ও দখলবাজি বিপরীত বার্তাই দেয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা যখন বিএনপির আমলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন মানুষ তাদের আমলের সঙ্গেও মিলিয়ে দেখতে চাইবে। কোন আমলে কত বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, কত বেশি সেকেন্ড হোম তৈরি হয়েছে তাও খতিয়ে দেখবে তারা।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি