‘তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে’—ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়কে জন্ম নেওয়া নবজাতকের জন্যই কি এ কথা লিখেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ ধরে নিই, তবে মা-বাবা ও বোনের অপঘাতে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুটি নির্ঘাত বলে উঠবে, ‘আমাকে তুই আনলি কেন? ফিরিয়ে নে।’
কবিরা নাকি ভবিষ্যৎ–দ্রষ্টা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আজকের বাংলাদেশের এই দিনের আগাম ছবি হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কল্পনার সীমা সীমিত। অবস্থাদৃষ্টে তারা বড়জোর কিছুটা অনুমান করতে পারে। তাতে কবির ‘জরাসন্ধ’ কবিতা থেকেই একটা পঙ্ক্তি নেবে তারা—‘অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকব, অন্ধকার হব’।
১৬ জুলাই ত্রিশালের কোর্ট ভবন এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক পার হতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন জাহাঙ্গীর আলম (৪২), তাঁর স্ত্রী রত্না বেগম (৩২) ও তাঁদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, ট্রাকচাপায় রত্নার পেট চিরে জন্ম নেয় এই নবজাতক। জাহাঙ্গীরদের বাড়ি ত্রিশালেই, রায়মনি গ্রামে। রাতেই বসতঘরের সামনে কবর দেওয়া হয় তাঁদের। সেখানে আগে থেকে আরও দুটি কবর ছিল। সব মিলিয়ে পাঁচটি কবর। এসব কবরে এক পরিবারের তিন প্রজন্মের মানুষ এবং তাঁরা সবাই সড়কে প্রাণ খুইয়েছেন। ২০০৪ সালে বাড়ির সামনে এই ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কেই দুর্ঘটনায় মারা যায় জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই শামসুল হক, সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এর আগে ১৯৯৫ সালে বাড়ির সামনে সড়কে প্রাণ যায় জাহাঙ্গীরের চাচা ফজলুল হকের।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জাহাঙ্গীর যেদিন বেঘোরে মারা পড়েন, সেদিন দেশজুড়ে আরও ২৮ জনের প্রাণ গেছে সড়কে। অর্থাৎ এক দিনে সড়কের বলি ৩১ জন। ‘মৃত্যু’ এ দেশে পরিসংখ্যানের বেশি কিছু কি না, এমন প্রশ্ন হয়তো তোলা যায়। ২০১৮ সালে রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মীমকে পিষে মেরেছিল একটি বাস। এরপর রাজপথে নেমে আসে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। তাদের একটাই চাওয়া ছিল, নিরাপদ সড়ক চাই। সরকারের তরফ থেকে এই কচি-কাঁচাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়, শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।
এ কথা বুঝেই বুঝি জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়া বেগমও বিচারের কথা বলছেন না। হ্যাঁ, কান্নার অবারিত অধিকার তাঁর আছে, তাই তিনি কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘এই সড়ক আমার পাঁচজন রে নিছে। এইবার থামাও। আমার বাবা রে ফিরাইয়া দিবা না। আর লাশ নিয়ো না।’
এরপর দেশের নদ-নদীর পানি আরও দূষিত হয়েছে, উজাড় হয়েছে আরও বন-বনভূমি, বাতাস ভরেছে আরও আরও বিষে, খাদ্যের মান ঠেকেছে আরও তলানিতে, সড়ক হয়েছে আরও ‘প্রাণঘাতী’। তাই সড়ক দুর্ঘটনার নতুন নতুন পরিসংখ্যান পাই, পরিত্রাণ মেলে না। অরাজকতাই যেন শেষ কথা, নৈরাজ্যের উদাহরণ হয়ে থাকে দেশের সড়ক-মহাসড়ক।
কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন চলে গেল যে মায়ের, কলিজার টুকরা, নয়নের মণিকে হারালেন যে বাবা, তাঁরা কি একমুহূর্তের জন্যও সন্তানশোক ভুলতে পারেন? সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একটি পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকেই কেড়ে নেয় না, বাকি সদস্যদের সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকে। ‘এই সড়কই আমারে নিঃশেষ করে দিছে। আমার দুইটা ছেলে রে নিছে। আমার ছোট ভাইটা রে নিছে’—জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমানের এই কথার সামনে তাই আমরা যতটা কুঁকড়ে যাই, তাঁর ‘(সড়ক) আর না জানি কারে কারে নেয়!’—এই কথার সামনে আরও বেশি মাথা নত হয়ে যায় আমাদের!
ছেলে, পুত্রবধূ, নাতনি ও ভাই হারানো মানুষটার এই কথার মধ্যে আছে অসহায়ত্ব, সান্ত্বনাটুকুও না পাওয়ার বেদনা। কেননা, এত এত অপঘাতে মৃত্যুর একটিরও বিচার দেখে না দেশবাসী। আগে দুই দফায় স্বজন হারিয়ে তিনি জানেন, এই তিন অপঘাত মৃত্যুও সময়ের তলায় চাপা পড়ে যাবে। আগামীকালই সংবাদ হবে নতুন দুর্ঘটনা। দোষী ব্যক্তির শাস্তি হলে অন্তত বাবার ভেঙে যাওয়া বুকে একটু শান্তির পরশ লাগত, ভুক্তভোগী মায়ের অন্তরাত্মার জ্বলুনি একটু লাঘব হতো। বিষণ্নতায় ঘিরে ধরা সন্তানের মনের ভার একটু কমত, ভাইবোনের হাহাকারে ছেদ পড়ত, স্বজনের দীর্ঘশ্বাস হালকা হতো...দেশবাসীর একটু ভরসার জায়গা তৈরি হতো।
সে ‘বন্দোবস্ত’ যেহেতু নেই, তখন অদৃষ্টকে দোষারোপ করা যায়, নিজের চুল নিজে ছেঁড়া যায়, আরও আরও অনেক কিছু করা যায়, শুধু কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানানো যায় না!
এ কথা বুঝেই বুঝি জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়া বেগমও বিচারের কথা বলছেন না। হ্যাঁ, কান্নার অবারিত অধিকার তাঁর আছে, তাই তিনি কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘এই সড়ক আমার পাঁচজন রে নিছে। এইবার থামাও। আমার বাবা রে ফিরাইয়া দিবা না। আর লাশ নিয়ো না।’ মা, আপনাকে বলি, সড়কে সবার শুধু স্বজন যায়, আপনারও গেছে; কিন্তু সড়কে জন্ম নিয়েছে আপনাদের উত্তরসূরিও। ওরাই হয়তো একদিন আলো হয়ে ‘অন্ধকার’ দূর করবে।
● হাসান ইমাম সাংবাদিক