তুরস্ক ও সিরিয়ার প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ। সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমের নিউজফিড বালুর প্রাসাদের মতো ধসে পড়া নতুন সব আবাসিক ভবনের ছবিতে সয়লাব হয়ে গেছে। এসব ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত কবর হয়েছে বাসিন্দাদের। এর অনেক কটিই বিলাসবহুল ভবন হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। আবাসন কোম্পানিগুলো বিক্রির সময় দাবি করেছিল, ভবনগুলোতে ‘অত্যাধুনিক ভূমিকম্প নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা হয়েছে।’
এসব ভবন নির্মাণের জন্য দায়ী অনেক ঠিকাদার তুরস্ক থেকে ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছেন। ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগে ১৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কয়েকজন আবাসন কোম্পানির মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তুরস্কের ন্যায়বিচারবিষয়ক মন্ত্রী বেকির বজদাজ বলেন, ‘যারা এর জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
তবে লোভ আর নির্লজ্জ মুনাফার জন্য যে বিপর্যয় ঘটেছে, সেটিকে শুধু আইনি অপরাধ বলে পার পাওয়া যায় না। সরকারি সংস্থার অনুমোদন, ভবন পরিদর্শকদের অনুমোদন এবং গবেষণাগারে নির্মাণ উপাদানের গুণগত মান পরীক্ষা ছাড়া এসব ভবন নির্মিত হয়নি। সরকার নির্মাণ ও আবাসন খাতে আইনের অনেক জায়গায় যে পরিবর্তন এনেছে, তারই আওতায় এসব ভবন নির্মিত হয়েছে। এ সবকিছুই তুরস্কের ধ্বংসাত্মক ও অতি লোভী নির্মাণ খাতের ফুলেফেঁপে ওঠার কারণ।
সরকারের দুর্নীতি ও অক্ষমতাকে খোলাসা করে দিয়েছে ভূমিকম্প। এ ধরনের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প তুরস্ক এবারই প্রথম দেখল না। যাহোক রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন একেপি ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে তুরস্কে। প্রতারণার জন্য কুখ্যাত তুরস্কের আবাসন খাত। এ খাতে দায়দায়িত্বহীন ঠিকাদারদের নিবৃত্ত করে ভূমিকম্পপ্রবণ তুরস্কে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় বের করার জন্য যথেষ্ট সময় তারা পেয়েছে; কিন্তু সেটি করা হয়নি।
ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবনগুলোর মধ্যে কতগুলো এরদোয়ান সরকারের দায়মুক্তি পেয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। উদ্ধারকারীরা ধসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপে এখনো জীবিত মানুষদের অনুসন্ধান করে চলেছেন। এর জন্য দায়ী কারা তার অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। ভয়াবহ এই বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী, তাদের সবাইকে যদি জবাবদিহির মধ্যে আনতে হয়, তাহলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লোভের জট প্রথমে খুলতে হবে।
এর পরিবর্তে, সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির তোয়াক্কা না করেই বিশালাকায় অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রকল্পে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান খাতে পরিণত করা হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার নির্মাণ ও আবাসন খাত, স্থানীয় সরকার ও গৃহনির্মাণে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নতুন আইন পাসের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থায় কাঠামোগত সংস্কারও করেছে। এর মধ্য দিয়ে নগর প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকে নগরায়ণ ও নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারগুলোকে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করা এবং সরকারি মালিকানাধীন ভূমি ও সম্পদ আবাসন কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করার ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
এর ফলে গরিব ও প্রান্তিক লাখ লাখ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিলাসবহুল ও উচ্চ মুনাফার আবাসন নির্মাণের জন্য পাড়া–মহল্লাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নগর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভবনগুলো ভূমিকম্প আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম কি না, সে বিবেচনা একেবারে করা হয়নি।
২০১৮ সালে পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তুরস্কে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ভবনের ক্ষেত্রে নির্মাণ ও নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর অর্থ, দেশটির অর্ধেকরও বেশি ভবন নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়নি। স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে ভূমিকম্পে তুরস্কের নগর ও শহরগুলো টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ আছে। কিন্তু তাদের সতর্কতাকে কেউ পাত্তা দেয়নি।
শুধু তা–ই নয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যখন এই অপরিকল্পিত ও অবাধ উন্নয়ন এবং নির্মাণে উৎসাহ দিয়ে চলেছে, সে সময় ক্ষমতাসীন একেপি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে শুধু চোখ বন্ধ করেই রাখেনি, স্বাধীন তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবকাঠামো ও নির্মাণ খাতের ত্রুটি তুলে ধরার কারণে ট্রেড চেম্বারগুলোর নেতাদের অব্যাহতভাবে অপমান করা হয়েছে। সমস্যাপূর্ণ ও বিপজ্জনক প্রকল্পে ট্রেড চেম্বারের নেতারা যাতে বাধা হয়ে না ওঠেন, সে জন্য তাঁদের বিশ্বাসঘাতক, অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা ব্যক্তি এমনকি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে আদালতে তোলা হয়েছে।
অবকাঠামো প্রকল্পের অনুমোদন ও নির্মাণ তদারকির ক্ষেত্রে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, নগর–পরিকল্পনাবিদদের বাদ দেওয়ার জন্য ২০১১ ও ২০১৩ সালে নতুন আইন পাস করা হয়েছে। তুরস্কের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের ইউনিয়ন থেকে একেপি সরকারের সমালোচকদের মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছে।
এরই মধ্যে তুরস্কের সরকার নির্মাণ ও আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজারে যাতে নিশ্চিন্তে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, সে জন্য নিজেদের দায়দায়িত্বটাও ত্যাগ করে। ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ তদারকির দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মুনাফা কীভাবে বাড়বে, সেটিই তারা প্রাধান্য দিতে থাকে। ঠিকাদাররা যা করেছেন, তার জন্য তাঁদের মধ্যে একবিন্দুও অনুশোচনা ছিল না, আর প্রকৌশলীরা নামমাত্র পরিদর্শনের বাইরে আর কিছুই করেননি।
এ ছাড়া এরদোয়ান সরকার আবাসন খাতে কথিত দায়মুক্তিও দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে তুরস্কে প্রথম ব্যাপকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ভবনের ক্ষেত্রে এ ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি নাগরিকদের জন্য সরকারি ‘উপহার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে অবৈধভাবে ও বিকল্প কাঠোমোয় নির্মিত ভবন সরকারকে কিছু ফি দেওয়ার বিনিময়ে বৈধ করার অনুমতি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে অবকাঠামো খাতে সর্বশেষ দায়মুক্তি দেওয়া হয়। অবৈধ ভবনের ক্ষেত্রে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দায়মুক্তি দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় একেপি। একবারে ৭৪ লাখ অবৈধ ভবন বৈধ করা হয়। এর বিনিময়ে ২৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন লিরা রাজস্ব আয় করে সরকার। পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই অর্থ তুরস্কের ভবনগুলো আরও বেশি ভূমিকম্প–সহনীয় করার কাজে ব্যয় করা হয়েছে।
গত সপ্তাহের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ২ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি ভবনকে দায়মুক্তি আইনের আওতায় বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্প যখন আঘাত হানে সে সময়ে আরেকটি বড় দায়মুক্তি আইনের খসড়া আইনসভায় অনুমোদনের জন্য অপেক্ষাধীন ছিল।
ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবনগুলোর মধ্যে কতগুলো এরদোয়ান সরকারের দায়মুক্তি পেয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। উদ্ধারকারীরা ধসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপে এখনো জীবিত মানুষদের অনুসন্ধান করে চলেছেন। এর জন্য দায়ী কারা তার অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। ভয়াবহ এই বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী, তাদের সবাইকে যদি জবাবদিহির মধ্যে আনতে হয়, তাহলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লোভের জট প্রথমে খুলতে হবে।
কনসটানজি লিজ দ্য গার্ডিয়ান–এর সাবেক তুরস্ক প্রতিনিধি
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে