পেজেশকিয়ান কি পারবেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) ছাপা পত্রিকায় এ লেখা প্রকাশিত হয়।

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর এ মাসের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একমাত্র সংস্কারপন্থী প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান বিজয়ী হন। হার্ট সার্জন ও সংসদ সদস্য পেজেশকিয়ান ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত খাতামি সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

ইরানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন তাঁকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ইরানের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রেসিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সামরিক, নিরাপত্তা নীতি এবং সামগ্রিক শাসন বিবেচনায় সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

১৯৭৯ সালের বিপ্লব-পরবর্তী নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব নির্বাচনে দুটি প্রধান বিষয় বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক। বিপ্লবের সময় ইরানের জাতীয় মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে ৭০ রিয়াল ছিল, এখন সেটা ৬ লাখ রিয়ালে গিয়ে পৌঁছেছে। ইরানের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও এখন স্থবির হয়ে গেছে। 

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইরানে রক্ষণশীল, মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা আরব ও ইসলামি বিশ্ব, বৈশ্বিক দক্ষিণ ও প্রাচ্যের মিত্র যেমন চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে। রক্ষণশীল, মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী প্রশাসনের মধ্যে মূল পার্থক্যটা হলো, পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি। এটাই ইরানের রাজনীতির প্রধান প্রতিবন্ধকতা। 

পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন ও মাত্রা নিয়ে ইরানের রাজনৈতিক উপদলগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা তিনটি মূল বিষয়ে একমত। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইরানের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি করেছে নিষেধাজ্ঞা। বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিপ্লব-পরবর্তী সব সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে প্রচেষ্টা চালিয়েছে; কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।

সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত ছিল ওবামা প্রশাসনের সময় সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি। ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে দৃশ্যমান উত্তেজনা কমিয়েছিল এই চুক্তি; কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে সরে আসে, বৈরিতা চূড়ান্ত মাত্রায় ওঠে। চুক্তিটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য রাইসির রক্ষণশীল সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সর্বোচ্চ নেতার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে, সরকার ও সংসদের ওপর নির্ভর করে না।

ইরানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে। সেগুলো হলো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পররাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, শাসনপদ্ধতি সংস্কার এবং বেসরকারীকরণ। পেজেশকিয়ান প্রশাসন এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে, যদি তাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, রেভল্যুশনারি গার্ড, বিচার বিভাগ ও সংসদের সমর্থন থাকে।

পেজেশকিয়ান সরকার দেশের ভেতরকার চ্যালেঞ্জ ছাড়াই এশিয়া, প্রাচ্য ও বৈশ্বিক দক্ষিণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে গেলে দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে বৈরিতা নিরসন না করতে পারলে পশ্চিমা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফ না গলা পর্যন্ত ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না। 

৪০ বছরের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ হলো, দুই দেশের মধ্যে অজস্র বিতর্কিত বিষয় থাকা সত্ত্বেও ইরান খুব সংকীর্ণভাবে পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর জোর দিয়ে চলেছে।

কয়েক দশক ধরে চলা ইরানের অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐকমত্য ও ঐক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন একটি নেতৃত্ব দরকার। ইরানে খামেনি শক্তিশালী নেতা, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য তঁার আছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে খামেনির মতো পেজেশকিয়ানও নিষেধাজ্ঞার চাপ কমিয়ে ইরানের অর্থনীতিকে উন্নতির ধারায় নিয়ে যেতে চান। 

পেজেশকিয়ান বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং পারমাণবিক চুক্তি পুনর্জীবনের মাধ্যমে তিনি নিষেধাজ্ঞার চাপ কমাতে চান। এর মানে হচ্ছে পেজেশকিয়ানের এসব উদ্যোগে খামেনির সম্মতি আছে; কিন্তু তার জন্য নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, নাকি সংঘাতের নীতি নেবেন, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের বড় কোনো পরিবর্তন হবে কি হবে না, সে বিষয়টি ওয়াশিংটনের হাতেই রয়েছে।

সৈয়দ হোসেন মুসাভিয়ান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ

মিউলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত