সাংবাদিক শফিউজ্জামান জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দের খবর হলেও শফিউজ্জামান স্বস্তিতে আছেন বলা যায় না। কেননা, তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল, সেটি প্রত্যাহার করা হয়নি। কোনো দোষ না করেও তাঁকে কয়েক দিন জেল খাটতে হয়েছে।
সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, সরকারি অফিসে অনুপ্রবেশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ এনে শফিউজ্জামানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শিহাবুল আরিফ।
ভ্রাম্যমাণ আদালত হলো একটি সংক্ষিপ্ত বিচারপদ্ধতি। এই আদালতে বিচারক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দোষী ব্যক্তিকে দণ্ড দিয়ে থাকেন। আইনের ৭ ধারাায় আছে, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে আনার পরপরই আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ লিখিতভাবে গ্রহণ করে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শোনাবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকার করেন কি না, জানতে চাইবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার না করলে তার কারণ জানতে চাইবেন। আর অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে, তাঁর স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর নিতে হবে। এরপর নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁর বিবেচনায় যথোপযুক্ত দণ্ড আরোপ করে লিখিত আদেশ দেবেন।’
কিন্তু শেরপুরের নকলায় ঘটনাস্থলে তো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। তাঁর কাছে অভিযুক্ত শফিউজ্জামান দোষও স্বীকার করেননি। তারপরও তিনি সরকারি অফিসে অনুপ্রেবশ ও অসদাচরণের অভিযোগে শফিউজ্জামানকে ছয় মাসের জেল দিয়েছেন। যিনি অভিযোগ করেছেন, নকলার ইউএনও ম্যাজিস্ট্রেটের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সরকারি অফিসে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাউকে ধরে আনতে বললে অধীনরা বেঁধে আনেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর শফিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোবাইল কোর্টে সাজা দেওয়ার আগে আমাকে সরি বলার জন্য বলেছিল। আমি বলেছি, আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমি এখানে তথ্য অধিকার ফরমে আবেদন নিয়ে এসেছি। আমি কোনো সরি বলতে পারব না। এরপর ওসিকে ফোন দেয়। আমি ও আমার বড় ছেলে সিসি ক্যামেরার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর ওসি সিভিল কাপড়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি, ভুল স্বীকারও করেননি।
ওই দিন দুপুরে শফিউজ্জামানের কারাদণ্ড দেওয়ার বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিএম) আবদুল্লাহ আল খায়রুমের আদালতে আপিল করেন আইনজীবী মো. আবদুর রহিম। আপিলে আইনজীবী উল্লেখ করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে শফিউজ্জামানকে দেওয়া সাজা বিধিসম্মত হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে শফিউজ্জামান দোষ স্বীকার করেননি। এ জন্য সাজার আদেশ রহিত ও বাতিলের আবেদন জানান আইনজীবী। ডিএম আবদুল্লাহ আল খায়রুম আপিলটি গ্রহণ করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) জেবুননাহারের আদালতে পাঠান।
বিকেলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে শুনানি শেষে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শফিউজ্জামান কারাগার থেকে মুক্তি পান।
শফিউজ্জামান দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার নকলা উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত। ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সাজায় ৫ মার্চ থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।
ইউএনওর দপ্তরে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শফিউজ্জামান বলেন, তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইতে ৫ মার্চ বড় ছেলে শাহরিয়ার জাহানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইউএনওর দপ্তরে যান।
তিনি তথ্য অধিকার আইনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ও জাইকার কয়েকটি প্রকল্পের বিষয়ে তথ্য চেয়ে আবেদন করেন এবং রিসিভড কপি চান। এতে ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন তাঁর (শফিউজ্জামান) ওপর ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। একপর্যায়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শিহাবুল আরিফকে ডেকে এনে ইউএনওর দপ্তরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁকে (শফিউজ্জামান) দুটি ধারায় কারাদণ্ড দেন। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো বিরল হলেও এটিই প্রথম নয়। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছিলেন সেখানকার ডিসি। তাঁর আগে মধ্যরাতে সাত–আটজন লোক ঢুকে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের সামনেই তাঁকে মারধর করেন। ডিসির আক্রোশের কারণ, কাবিখার টাকায় পুকুর সংস্কার করে তিনি নিজের নাম বসিয়ে যে মাহাত্ম প্রচার করেছিলেন, সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন আরিফুল।
এ বিষয়ে ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনের ভাষ্য হলো, ‘সাংবাদিক রানা তথ্য চেয়ে আবেদন করতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তখনই তথ্য চান। আমি তাঁকে বলি, এখন আমার মিটিং আছে। তথ্য দেওয়ার জন্য আমার হাতে ২০ দিন সময় আছে। কিন্তু রানা সিএ শীলার কাছে থাকা তথ্যের ফাইল টানাটানি করেন এবং নানা ধরনের অশালীন ভাষায় কথাবার্তা বলেন। তিনি অসদাচরণ করেছেন। এতে অফিসের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তাই আমি সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে বলেছি।’
এ ঘটনার পর সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠন নিন্দা জনিয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরও সাংবাদিককে তথ্য না দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয় তথ্য কমিশন। গত রোববার সকালে তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম (ঝিনুক) শেরপুরে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। সোমবার দুপুরে কার্যক্রম শেষ করে তিনি ঢাকায় ফিরে যান।
তথ্য কমিশনের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে আরও যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের তথ্য দিতে গড়িমসি করে, তাদের বিষয়েও তাদের অনুসন্ধান চালাতে বলব তাদের। তথ্য অধিকার আইন তো ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ হলে হবে না। শুরুতে তথ্য চাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকদের অনাগ্রহ থাকলেও সাম্প্রতিককালে বেশ উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা তথ্য দিতে গড়মসি করেন। তারা মনে করেন, তথ্য দিলেই তাদের দোষ ও দুর্বলতা ফাঁস হয়ে যাবে। নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে সে রকম কিছু হয়েছে কি না, তদন্ত করে দেখা দরকার।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো বিরল হলেও এটিই প্রথম নয়। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছিলেন সেখানকার ডিসি। তাঁর আগে মধ্যরাতে সাত–আটজন লোক ঢুকে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের সামনেই তাঁকে মারধর করেন। ডিসির আক্রোশের কারণ, কাবিখার টাকায় পুকুর সংস্কার করে তিনি নিজের নাম বসিয়ে যে মাহাত্ম প্রচার করেছিলেন, সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন আরিফুল।
শেরপুরের নকলার শফিউজ্জামান ইউএনওর বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট করেননি। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন রিপোর্টের তথ্য সংগ্রহ করতে। ইউএনও অভিযোগ করেন, সাংবাদিক শফিউজ্জামান তাঁর ও ওই অফিসের আরেকজন নারী কর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন। তাঁর এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত নয়। কিন্তু তিনি যে একজন সাংবাদিককে তথ্য চাওয়ার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে পাঁচ দিন জেল খাটালেন, সেটা কি অসদাচরণ নয়। শফিউজ্জামান এখন কার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাবেন? সরকারি কর্মকর্তা হলেই তাঁরা জবাবদিহির উর্ধ্বে থাকতে পারেন না।
কুড়িগ্রামের ঘটনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দ্রুত ডিসিকে প্রত্যাহার করেছিলেন। নকলার ইউএনও এখনো বহাল আছেন। সাংবাদিক আরিফুল ডিসিসহ চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাঁর বাড়িতে হামলা ও হত্যাচেষ্টার যে মামলা করেছিলেন, তার তদন্তই শেষ হয়নি। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করলে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে দ্রুত তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আর সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে চার বছরে তার তদন্ত কাজই শেষ হয় না। এটাই কি ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের নমুনা?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি