২০১৯ সালে লন্ডন সম্মেলনের আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ন্যাটোর ব্রেন ড্রেড বা মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বিশ্ব সেই দিন পেরিয়ে এসেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ন্যাটোর এমন পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে, যেটা জোটের ৭৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়নি। এ সপ্তাহে লিথুয়ানিয়ায় ন্যাটো সম্মেলনে সেই উদ্দীপনাটাই দেখা গেল।
মাখোঁর যুক্তি ছিল, ইউরোপের নিরাপত্তা বিবেচনায় যখন সদস্যদেশগুলোর যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি অথবা একই ধরনের উদ্দেশ্য নেই, তখন দায় ভাগ করে নেওয়ার জন্য তাদের বিবাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি দাবি করেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ হলো সাধারণ শত্রু, যেটা চীন কিংবা রাশিয়া নয়, আমাদের ‘সবগুলো দেশকে আঘাত করেছে’। তিনি এ বিষয়েও জোর দিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে কম নির্ভরযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ কারণে ইউরোপকে তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
সদস্যদেশগুলোর মধ্যে দায় ভাগ করে নেওয়ার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যে উত্তেজনা বাড়ে। ইউরোপীয় সদস্যরা সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়েছে এবং সম্মিলিত নিরাপত্তার বিষয়টি খাটো করে দেখছে, এ রকম ভুল অভিযোগ তোলেন ট্রাম্প। জোট থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের চার বছরে ন্যাটোর অস্তিত্ব ছিল নিবু নিবু অবস্থায়।
সোভিয়েতকে দূরে রাখা, জার্মানদের সরিয়ে আমেরিকানদের জায়গা তৈরি করতে ওয়াশিংটন থেকে ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি হওয়ায় জোটটি এর মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ওয়ারশ চুক্তি বাতিল এবং দুই জার্মানির একত্রীকরণ, এ সবকিছুই একটা যুগের পরিসমাপ্তি ও নতুন যুগের জন্মের প্রতীক। আরও ঐক্যবদ্ধ, নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী ইউরোপের জন্মের প্রতীক।
এরপর বলকান যুদ্ধ শুরু হলে তাতে ন্যাটোর হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এরপর আসে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার ঘটনা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদটি সচল করে জোটটি। নিজেদের এলাকার বাইরে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে ন্যাটো। নতুন ধরনের হুমকি ও শত্রুর বিরুদ্ধে জোটটি তার সামরিক সক্ষমতা আরও সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে আগ্রাসনের সময় বিভক্তি দেখা যায়, যেটি জোটটির রাজনৈতিক ও সামরিক সংহতিকে খাটো করেছে। ২০০৪ সালে দায় ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাতে ইরাকে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে। ফলে ২০১১ সালে ইরাক থেকে ন্যাটো নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেটের’ উত্থান যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোর আরেকটি বড় ব্যর্থতা।
সরাসরি না হলেও ন্যাটো লড়াই চালিয়ে যেতে ও রাশিয়াকে দুর্বল করতে এবং ভবিষ্যতে পুতিনকে এ ধরনের আগ্রাসন থেকে বিরত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা এবং সর্বাধুনিক ও ক্লাস্টার বোমার মতো বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে ন্যাটো প্রমাণ করেছে যে ইউক্রেনে শেষ সেনাটা জীবিত থাকা পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
ইরাক দখল যদি আমেরিকানদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহা ভুল হয়, তাহলে আফগানিস্তান দখল ছিল ন্যাটোর জন্য ভয়ানক এক অবমাননা। ২০ বছরের এই খরুচে যুদ্ধ শেষ হয় ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর লজ্জাজনক ও তালগোল পাকানো প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়বারের মতো তালেবান শাসন ফিরে আসে।
এটাই সবকিছু নয়। ২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসন তালগোল পাকানো বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। আট মাস ধরে লিবিয়ার বাহিনীর ওপর প্রায় সাত হাজারবার বোমা হামলার পর মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে লিবিয়ায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যে যুদ্ধ দেশটিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। বারাক ওবামা পরবর্তীকালে এই আগ্রাসনকে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দায়িত্বকালে সবচেয়ে খারাপ ভুল।
পূর্বমুখী সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে ন্যাটো ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে অথবা একুশ শতকে তাদের একেবারে মূল কৌশলনীতি কী হবে, সেটা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বমঞ্চে ‘আমেরিকার প্রত্যাবর্তন’ ঘোষণা দেন। পূর্বসূরিরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাকি বিশ্বের নির্ভরশীলতা ও আস্থার ক্ষেত্রে যে ক্ষতিটা করেছিলেন, সেটা পুষিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেন তিনি। ইউরোপে ন্যাটো জোট নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, সেটা মীমাংসা করে জোটটিকে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্ধার করার উদ্যোগ নেন বাইডেন।
২০২২ সালে সবকিছুর পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর নাটকীয়ভাবে সব সংশয় উবে যায়।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দীর্ঘদিন ধরে তাঁর প্রভাবাধীন এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোর হস্তক্ষেপ করছে বলে সতর্ক করে আসছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন, জর্জিয়া ও ইউক্রেন সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটো নিজেদের সম্প্রসারণ করতে চাইছে। কিন্তু তার এই বক্তব্যের পাত্তা দেয়নি ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউসে বাইডেন প্রশাসন তখন আন্তআটলান্টিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের মনোযোগী ছিল।
ন্যাটোর পুনরেকত্রীকরণ প্রচেষ্টার এক বছরের মাথায় ইউক্রেনে পুতিন আগ্রাসন শুরু করে। পুতিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় নেতারা প্রতারিত বোধ করলেন। তাঁরা হিসাব কষে দেখলেন, পূর্ব দিকের সীমান্তে যে নতুন বিপদ উপস্থিত হয়েছে, তা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটকে শক্তিশালী করা ছাড়া তাঁদের সামনে বিকল্প নেই।
যে ফিনল্যান্ড সব সময় ন্যাটো থেকে দূরে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে, তারা এখন যেকোনো মূল্যে ন্যাটোয় যুক্ত হতে চায়। তুরস্কের আপত্তির কারণে জোটে যুক্ত হতে না পারার কারণে সুইডেন যেটা করেছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ইউরোপীয়রা এখন কী চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত তুরস্ক তাদের আপত্তি তুলে নেয়।
সরাসরি না হলেও ন্যাটো লড়াই চালিয়ে যেতে ও রাশিয়াকে দুর্বল করতে এবং ভবিষ্যতে পুতিনকে এ ধরনের আগ্রাসন থেকে বিরত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা এবং সর্বাধুনিক ও ক্লাস্টার বোমার মতো বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে ন্যাটো প্রমাণ করেছে যে ইউক্রেনে শেষ সেনাটা জীবিত থাকা পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
পশ্চিমা একটা সময় ধরে বড় ধরনের অস্থিরতার পর পুতিন ন্যাটোকে নতুন অর্থ ও প্রেরণা দিয়েছে। আগে কি কেউ ভেবেছে জাপানে ন্যাটোর লিয়াজোঁ কার্যালয় হবে?
মারওয়ান বিশারা, আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত