কিছুদিন আগে এক শনিবার প্রকৌশলী ফজলুল হকসহ দেখে এলাম রংপুরের নলেয়া নদী। একই সঙ্গে রংপুরে আমার একমাত্র না দেখা শান নদীও। শান নদীর পাশে শানেরহাট নামক একটি বাজার আছে। পাশেই একটি সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেতুর ভাটিতে খনন করেছে। সে অংশটি নদীর অবয়ব পেলেও উজানের অংশ সমতল ফসলি জমির মতো হয়ে আছে।
শান নদীর কাছেই সহকর্মী অধ্যাপক গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাড়ি। ফোনে তিনি বললেন, ‘ওই নদীর পাশ দিয়েই শৈশব কেটেছে। ওই নদীতে আগে স্রোত ছিল। এখন তো দেখছেন অবস্থা কেমন হয়েছে!’ বয়স্ক ব্যক্তিরাও জানালেন, নদীটি গত ২০-২৫ বছর আগেও ভালো ছিল।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার শেরুডাঙ্গা বিল থেকে উৎপন্ন হয়েছে নলেয়া নদী। গত বছর শেরুডাঙ্গায় গিয়ে দেখে আসি এ নদীর উৎস। নলেয়া ও শান নদী মিলিত হয়েছে পীরগঞ্জ উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের শাহাপুর গ্রামে। মিলনস্থলের উত্তরে পাঁচগাছি ও ভাটিতে শানেরহাট ইউনিয়ন। মিলনস্থল থেকে নদীটি নলেয়া নাম অবিকৃত রেখে ভাটিতে পীরগঞ্জের মাদারগঞ্জ, গাইবান্ধার মিরপুর, ঢোলভাঙ্গা হয়ে গোবিন্দগঞ্জের কাছে কাটাখালী নদীতে মিলিত হয়েছে।
খননের পর নদী বেশ খানিকটা দৃশ্যমান হয়েছে। কিছুটা ভাটিতে গিয়ে বড় নদীতে ছোট সেতু দেখে বিস্মিত হলাম। ৫০ মিটার নদীর পানি ১০ মিটার সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া কীভাবে সম্ভব! আরও কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে বড়পাহাড়পুর গ্রামে গিয়ে দেখলাম, সেখানেও সেতু প্রায় ১০ মিটার। দেখলাম নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, নিষেধ করা সত্ত্বেও বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। একজন বলছিলেন, ‘পুলিশ আসছিল। পুলিশের সঙ্গে ওদের কী কথা হইচে আমরা জানি না। কিন্তু বালু তোলা বন্ধ হয় নাই।’
আরও ভাটিতে একবারপুর গ্রাম। সেখানে নলেয়ার ওপরে একটি বড় সেতু দেখলাম। দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মিটার হবে। সেতুটি অনেক নিচু। একটি নদীতে কোথাও ১০ মিটার কোথাও ৫০ মিটার সেতু কীভাবে হয় এটা বোধগম্য হলো না। সব স্থানেই ৫০ মিটার সেতু হওয়া উচিত ছিল। এ নদীতে আরও কয়েকটি সেতু দেখলাম—সব কটিই নদীর মাপের চেয়ে অনেক ছোট।
নদীর পাশে পানেয়া গ্রামের পাকুড়তলায় কয়েকজন মিলে নলেয়া নদীতে মাছ ধরছিল। সামনেই নদীর জমিতে পুকুর চোখে পড়ল। স্থানীয় লোকজনই বলছেন, আগে যেদিক দিয়ে নদী ছিল, সেখানেই এখন পুকুর। সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে দুটি পক্ষ তৈরি হলো এবং উচ্চবাচ্য শুরু হলো। এক বয়স্ক ব্যক্তি বলছেন, ‘টিভিতে শুনছি সরকার সোগ নদী উদ্ধার করবে। এটা নদী যামরা খায় তামার কাগজ নাই।’ তখন একজন মাঝবয়সী ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘বাপ খায়া আসছে। সরকার খারিজ দিছে, খাজনা নেয়। এ নদী হামার।’ আমরা বিরোধ থামিয়ে আরও ভাটিতে মাদারগঞ্জ চলে যাই। প্রকৃত নাম মাদারগঞ্জ বন্দর, অনেক দোকানের সাইনবোর্ডে সেটিই লেখা আছে এখনো।
দুপুরের খাওয়ার সময় হোটেলের মালিক বলছিলেন, ‘চৈত মাসেও নলেয়া নদীত অনেক পানি ছিল। হামরা ডুবি ডুবি মাছ ধরছি। কাটাখালী থাকি মানুষ নৌকাত আসি ধান পাট কিনি নিয়ে গেইচে। হামরায় দেখচি।’ নদীটি গাইবান্ধা ও রংপুরের সীমানা তৈরি করেছে মাদারগঞ্জে। মাদারগঞ্জে উদয়পুর সেতু আছে। তার ভাটিতে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার মিরপুর বাজার আর উজানে পীরগঞ্জের মাদারগঞ্জ।
আমরা বাজারের কাছে দুটি স্থান পরিদর্শন করি। উদয়পুর সেতুর পাশে বয়সী অনেকেই বললেন, অতীতে এ নদী অনেক স্রোতস্বিনী ছিল। মাদারগঞ্জ এ নদীর তীরেই গড়ে ওঠে বন্দর। সেতুর পাশে মিজানুর রহমান নামের এক দোকানমালিকের কাগজ দেখলাম, নতুন রেকর্ডে অবৈধ দখল নিয়েছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নদীটি খনন করতে গেলে প্রায় তিন শ ব্যক্তি নদীর মালিকানা দাবি করে লিখিত অভিযোগ করেন। মিজানুরও তঁাদের একজন। তঁাদের দাবি, এ জমি খনন করতে গেলে তঁাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
নলেয়ার অধিকাংশ অংশই ব্যক্তির নামে লিখে নিয়েছে। যেহেতু ভূমি অফিস খাজনা নেয়, তাই অবৈধ দখলদারেরা মনে করেন এ নদীর মালিক তঁারা। মিজানুর কিছু দলিল, খতিয়ান ও নামজারির কাগজ বের করে বললেন, ‘আমি কাগজগুলো রেখেছি কোনো দিন কেউ আসলে দেখানোর জন্য। এখানে কোনো নদী নেই। সব ব্যক্তির জমি।’ কাগজে দেখা গেল, যে দাগ নম্বরের জমি তিনি দাবি করছেন, তা ১৯৪০–এর সিএস নকশায় এবং ১৯৬২ সালের রেকর্ডে সরকারের সংরক্ষিত জমি। ১৯৯০ সালের রেকর্ডে ওই জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে দলা। আইন অনুযায়ী নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। জমি সরকারের সংরক্ষিত শুনে তিনি জানতে চাইলেন, এ জমিতে সরকার হস্তক্ষেপ করবে কি না? আমরা বললাম, আইন অনুযায়ী এ জমি ব্যক্তির পাওয়ার সুযোগ নেই। যিনি লিখে দিয়েছেন এবং যিনি লিখে নিয়েছেন—উভয়েই অপরাধী। যোগসাজশে এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ কথা মিজানুরের মুখে চিন্তার ছাপ ফেলে দেয়।
সরেজমিনে দেখলাম, নদীটিতে অসংখ্য ছোট সেতু পানির প্রবাহ দুর্বল করে তুলেছে। ফলে দ্রুতই নদটি ভরাট হয়েছে। নদীটির পরিচর্যা কখনোই হয়নি। এগুলো যখন ভরাট হতে শুরু করেছে, তখনই ভূমি কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্যক্তির নামে নদী লেখার কাজ হয়েছে।
এখন এই নদী যদি উদ্ধার করে পরিচর্যা করা না যায়, তাহলে নলেয়া বিলুপ্ত হবে। নদীর দুই পাশের এলাকায় সীমাহীন জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। তৈরি হবে দুর্ভোগের এক জনপদ। তখন কি একই মানুষেরা নলেয়ার জন্য আফসোস করবে না?
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। [email protected]