তিন বছর আগে জো বাইডেন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনগুলো আশাবাদী হয়েছিল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীরা আশা করেছিল, এবার হয়তো ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বাইডেনের পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী সরকার সর্বাত্মকভাবে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থীদের প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছিল। ট্রাম্পের বর্ণবাদী আচরণে এখন পর্যন্ত অনেকে মনে করে থাকেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য ট্রাম্পের সরকারই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মার্কিন সরকার।
কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, বাইডেন গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাভিত্তিক আগ্রাসনকে আলিঙ্গন করেছেন। গাজায় ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে, পানি, খাবার ও ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে পৈশাচিক উন্মাদনায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাতে বাইডেন সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন। এই নৃশংসতাকে তিনি সরাসরি ন্যায্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে বাইডেন ধামাচাপা দিচ্ছেন এবং ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডার পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি গাজার আল আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়ে সেখানে থাকা রোগী ও আশ্রয় নেওয়া ৪৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে এক দিনে হত্যা করা হয়েছে। ইসরায়েল বলছে, এ হামলা তারা করেনি, এটি নাকি ইসলামিক জিহাদের কাজ। ইসরায়েলের এই দাবি যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তা প্রমাণে ভূরি ভূরি তথ্য হাজির করার পরও বাইডেন ইসরায়েলের দাবিকে সমর্থন দিয়েছেন।
সব দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে অমানবিক ফ্যাসিবাদী আচরণ করার দিক থেকে বাইডেন তাঁর পূর্বসূরি ট্রাম্পকে ছাড়িয়ে গেছেন।
বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তাদের ভাষায় ‘ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাতের’ সৎ ও নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী ছিল না, এখনো নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরায়েলপন্থী আচরণ করেছে এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবিক অধিকারের বিষয়গুলো অস্বীকার করে এসেছে।
ফিলিস্তিনিদের জীবন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই, তা ইসরায়েলের গণহত্যায় ব্যবহার্য মারণাস্ত্র সরবরাহ করে, ইসরায়েলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে, নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে, এমনকি ফিলিস্তিন অভিমুখে বিমানবাহী রণতরি পাঠিয়ে ওয়াশিংটন স্পষ্ট করে দিয়েছে।
ওয়াশিংটন কখনোই ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের শক্তি ও প্রভাবকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেনি। উল্টো ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করার কাজে ইসরায়েলকে মদদ দিতে ইসরায়েলের প্রতি সামরিক সহায়তার বন্যা বইয়ে দিয়েছে। এমনকি আমেরিকার অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বাধীন ‘প্রগতিশীল’ আমেরিকান সরকার ইসরায়েলকে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন দিয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে অভিন্ন অবস্থানে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মৌসুমে উভয় দলের শিবির থেকে কে কার চেয়ে বেশি ইসরায়েলপন্থী, তা প্রমাণে সমানে প্রচার চালানো হয়ে থাকে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে সম্মত হওয়ার পরও তা তাদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের অনীহা দেখা যায়। ফিলিস্তিনে ওয়াশিংটনের মিশনের ঘনিষ্ঠ প্যালেস্টাইন অথরিটিকে জাতিসংঘের ইউএনআরডব্লিউএ (ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস) তহবিল থেকে যে ত্রাণ দেওয়া হয়ে থাকে, সেই তহবিলে বাইডেনের পূর্বসূরি ট্রাম্প সব ধরনের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেছিল। বাইডেন ট্রাম্পের সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে পুনরায় সেখানে তহবিল বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বাইডেন সেই তহবিল ছাড় করছেন, এমনভাবে যাতে শুধু ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রিত এলাকার নজরবন্দী থাকা ফিলিস্তিনিরাই সে ত্রাণ পেতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের জীবন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই, তা ইসরায়েলের গণহত্যায় ব্যবহার্য মারণাস্ত্র সরবরাহ করে, ইসরায়েলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে, নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে, এমনকি ফিলিস্তিন অভিমুখে বিমানবাহী রণতরি পাঠিয়ে ওয়াশিংটন স্পষ্ট করে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান আশ্চর্যজনকভাবে আদিবাসী আমেরিকানদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে আসা প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মনোভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফিলিস্তিনিদের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কোনো প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ হিসেবেও দেখা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্রেফ বিরক্তিকর গোষ্ঠী বলে মনে করে। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে পারেনি। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা যেভাবে সেখানকার আদিবাসী আমেরিকান ও উপজাতিদের ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে দেখে এসেছে এবং সব সময়ই তাদের নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে এসেছে, ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন সেই একই ধারণা নিয়ে এগিয়েছে। যেহেতু আদিবাসী লোকদের উচ্ছেদ করে উপনিবেশ গড়াই আমেরিকান জাতি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি, সেহেতু ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে ইসরায়েলের দখলদারিকে তারা ন্যায্য হিসেবে দেখে এসেছে।
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থ এবং চাওয়া–পাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে বাস্তববাদী। সে কারণে ফিলিস্তিনিরা দরিদ্র, দুর্বল এবং ভৌগোলিকভাবে আণুবীক্ষণিক হলেও তাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের অনুকম্পা বোধ করে না। তাই যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখতে বাধ্য হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ফিলিস্তিনিদের জীবন, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার অধিকারকে উপেক্ষা করতে থাকবে।
ফিলিস্তিনের ব্যাপারে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের জন্য দুটি জিনিসের প্রয়োজন। একটি হলো এমন একটি পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিবেশ দরকার, যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিকল্পগুলো ও বিশেষাধিকারগুলোকে পরিচালনা করতে পারবে। আরেকটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন সংগঠনকে শক্তিশালী করা, যারা সেখানকার দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ওপর ফিলিস্তিন ইস্যুতে কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত।
হায়দার ঈদ গাজার আল-আকসা ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক