একসময় এ দেশে দলে দলে প্রার্থী, ঝাঁকে ঝাঁকে ভোটার ছিল। অলিগলিতে লম্বা লম্বা ভোটের মিছিল এবং কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ লাইন। টিনের চোঙায় ‘ভোট দেবেন কাকে’—স্লোগানে গ্রাম-শহরের আকাশ–বাতাস মুখর হতো। হাতে লেখা বা লেটার প্রেসে কাঠের ব্লকে সাদাকালো পোস্টার। টিনের চোঙা ও লেটার প্রেসের যুগ বহু আগে শেষ হয়েছে।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর টিনের চোঙা আর লেটার প্রেসের যুগের পর এল লাউড স্পিকার আর অপসেট প্রেসের যুগ। হোন্ডা-গুন্ডার যুগ। মাইকের চিৎকারে কান ঝালাপালা, লেমিনেটেড পোস্টারে আকাশ ঢেকে ফেলে। মাইকের পর এখন পরপর ডিজিটাল, স্মার্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ চলছে। ডিজিটাল পোস্টার-ফেস্টুন, অনলাইন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ছে।
অধুনা নির্বাচন ও ভোট বাংলা ভাষার অভিধানে অনেক পুরোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে নতুন অভিব্যক্তি ও অর্থ দিয়েছে। যেমন ভোট চুরি, ভোট ডাকতি, রাতের ভোট, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। আবার প্রার্থী অপহরণ, পোলিং, এজেন্টকে ভোটের চাঁদরাতে অন্য জেলায় চালান করা এবং নির্বাচন নিয়ে আরও নানা বিচিত্র সব ঘটনার নিষ্ঠুর রসিকতা।
এসব দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর খোদ নির্বাচনব্যবস্থাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম–৮ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে এক রসিকপ্রবর বললেন, জনগণকে ঘুমে রেখে পুরো নির্বাচনই ‘গুম’ হয়ে গেছে। কোনো এক প্রার্থী বিজয়ী হয়ে বগল বাজিয়ে চলেছেন। আর সাধারণ মানুষ ও সংবাদমাধ্যম হন্যে হয়ে নির্বাচন, ভোট ও ভোটার খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চান্দগাঁওয়ের হামিদচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট পাওয়া গেল। কিন্তু ভোটার গেল কই? বলা হচ্ছে, নির্বাচন কর্মকর্তার ১ শতাংশ ভোট কাস্ট করার অধিকার নির্বাচন কমিশনস্বীকৃত। আর এক কেন্দ্রে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সর্বসাকল্যে ১৯০টি কেন্দ্র মিলিয়ে টেনেটুনে ১৪ শতাংশ। (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩)। বাকি ৮৬ শতাংশ ভোটার গুম হলো না অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইল? কেউই কিছু বলে না।
কারণ, বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কোনো এক বোকা রাজার রাজ্যের চতুর এক মন্ত্রীর পাখি গণনার গল্প শোনা গেল। চট্টগ্রাম-৮–এর চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনে মোট পাখির সংখ্যা ধরা যায় প্রায় পাঁচ লাখ। কমসে কম ২০ শতাংশ ঈদে গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরেনি, ১৫ শতাংশ ভাসমান, ঠিকানা পরিবর্তন করে নগরের অন্য কোথাও বা বেয়াই বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত খেতে চলে গেছে। ১৪ শতাংশ ভোট ইভিএম মেশিনে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনীর, যারা বুক দিয়ে কেন্দ্র আগলে রেখেছিল তাদের মূল্যবান অবদান, আর ৭ শতাংশ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ডিজিটাল বদান্যতা। বাকি ৫১ শতাংশ ভোটার ভোটের দিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত প্রাণভরে ঘুমিয়েছে। রাজার হিসাব সুন্দর মিলে গেছে। রাজা খোশ, মন্ত্রীও খোশ। নাখোশ জনগণ অন্ধকারের বদ্ধ ঘরে কালো বিড়াল খুঁজতে খুঁজতে এখন ভুলে যেতে পারে এ দেশে একদা ভোট হতো।
ভোটের তো এই হাল। দেশের রাজনীতির কী হালহকিকত। রাজনীতিতে ‘মানি লন্ডারিং’ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। রাজনীতিকে কোনোভাবে আর দেশে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। দেশের রাজনীতি হুরবুর করে বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রার্থী আসে, ইউটিউবে নানা সংবাদ ভাষ্য, বিপ্লব, গণতন্ত্র সবই এসে দেশ সয়লব। দেশের সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের মুখে আপাতত ললিপপ। আর কিছু অসার গপসপ।
আগের দিনের ঢাউশ দেয়ালঘড়ির দোলকের মতো রাজনীতি এখন দিল্লি, মস্কো, চীন ও ওয়াশিংটনের পেন্ডুলামে দোল খাচ্ছে, আর টিকটিক আবর্তিত হচ্ছে। দিক পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ নেই। দেশের চার সিটি নির্বাচনের সিটি তো বাজল। এই ইদুঁর-বিড়াল খেলা তো জুনের মধ্যে শেষ। তারপর প্রয়াত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে চোরের গাট্টি নিয়ে নিরাপদে সরে পড়ার মতো কাপুরুষ গৃহস্থের বারবার একই চিন্তা ‘দেখি না বেটা কী করে?’ অবশেষে চোর অবশ্য সদর রাস্তা ধরে চলে যায়।
যাঁরা এসব নির্বাচনে এইভাবে বিজয়ী হন, তাঁদের আত্মসম্মানবোধ কোথায় গিয়ে লুকায় কে জানে! আসল–নকল মিলিয়ে ১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তাঁরা কীভাবে বিজয়ের মালা গলায় তোলেন?
ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ