সোমবার মার্কিন কংগ্রেসের কাছে হোয়াইট হাউস থেকে জরুরি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। সেই চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউক্রেন যদি নতুন করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা না পায়, তাহলে যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে তারা শিগগিরই পরাজয়ের মুখে পড়বে।
কংগ্রেসের নেতাদের কাছে লেখা চিঠিতে ব্যবস্থাপনা ও বাজেট–সংক্রান্ত কার্যালয়ের পরিচালক শালান্ডা ইয়াং লেখেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে কংগ্রেসের পদক্ষেপ ছাড়া এ বছরের শেষ নাগাদ ইউক্রেনের জন্য আরও অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মজুত থেকে সরঞ্জাম দেওয়ার মতো অর্থ থাকবে না।’
চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘এ মুহূর্তে যে তহবিল প্রয়োজন, সেটা জাদুকরিভাবে কেউ জোগাবে না। আমাদের অর্থ ফুরিয়ে আসছে এবং সময়ও প্রায় ফুরিয়ে আসছে।’
গত অক্টোবর মাসে হোয়াইট হাউস কংগ্রেসের কাছে ১০৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পূরক অর্থায়ন বিল অনুমোদনের জন্য পাঠায়। এ অর্থ ইউক্রেন, ইসরায়েল ও ইন্দো-প্যাসিফিকের মিত্রদের সহযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজে ব্যয় হবে। যা–ই হোক, এই বিলের ওপর দুই দলের (ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান) সমঝোতার ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও এর আগেরবার ইউক্রেনকে সহযোগিতার জন্য কংগ্রেসে তোলা অর্থায়ন প্যাকেজ দুই দলেরই ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি সভায় এ ইস্যুতে বিতর্ক বেড়ে চলেছে।
কংগ্রেসে কট্টর ডানপন্থী রিপাবলিকানদের দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়েছে। ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সহযোগিতা দেওয়ার বিরোধী তারা। এ পরিস্থিতিতে প্রতিনিধি সভার নতুন স্পিকার মাইক জনসনকে অবশ্যই সিনেটের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে হবে।
ইয়াং তাঁর চিঠিতে এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন হীনবল হয়ে পড়বে। তাতে করে ইউক্রেনীয় বাহিনী এখন পর্যন্ত যতটা অর্জন করতে পেরেছে, তা তারা শুধু খোয়াবেই না, রুশ সেনাবাহিনীর বিজয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।’
হোয়াইট হাউস আসলে সহযোগিতার জন্য অতিরিক্ত কত অর্থের কথা বলছে?
হোয়াইট হাউস থেকে অক্টোবর মাসে সম্পূরক অর্থায়নের জন্য যে খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে ইউক্রেনের জন্য কমবেশি ৬০ বিলিয়ন অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও মার্কিন কংগ্রেসে এ পর্যন্ত ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ১১১ বিলিয়ন ডলার অর্থের অনুমোদন দিয়ে রেখেছে।
ইয়াংয়ের তথ্যমতে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের জন্য বরাদ্দ পাওয়া ৬২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ৯৭ শতাংশই ব্যয় করে ফেলেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে বরাদ্দ পাওয়া ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের কিছুই অবশেষ নেই। ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক সমর্থনের বিষয়টি উল্লেখ করে ইয়াং জোর দিয়ে বলেন যে বিপর্যয় ঠেকাতে কংগ্রেসকে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ইয়াং লেখেন, ‘এটা আগামী বছরের সমস্যা নয়। গণতান্ত্রিক ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সহযোগিতা জোগাতে কংগ্রেসকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সমঝোতার বিষয়টি কোন প্রশ্নে আটকে আছে?
সম্পূরক সহযোগিতা প্যাকেজ, যা কংগ্রেসের দুই কক্ষেই পাস হতে হবে, সেটি এখন ঝুলে আছে। মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভায় রিপাবলিকান বিলটিতে আরও কঠোর নীতি আনতে চান। বিশেষ করে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং প্যারোল আবেদনের মতো বিষয়গুলোতে তাঁরা কঠোর নীতি চান। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রস্তাব অনেক ডেমোক্র্যাটের জন্য অগ্রহণযোগ্য।
এই বিলের ওপর বিতর্কে অংশ নেওয়া ডেমোক্র্যাটদের অন্যতম শীর্ষ আলোচক হলেন ক্রিসিস মারফি। কানেটিকাটের এই সিনেটর গত সোমবার পলিটিকোতে বলেন, কট্টর ডানের রিপাবলিকানরা ইউক্রেনকে আরও অর্থায়নের এই বিলে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে ‘সীমান্ত বন্ধ’ করে দিতে চান।
কট্টর ডান রিপাবলিকানরা কেন বিরোধিতা করছেন?
রিপাবলিকান দলের যত বেশিসংখ্যক সদস্য পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা সবার প্রথমে’ নীতি গ্রহণ করছেন, ততই ডানপন্থী আইনপ্রণেতারা ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার প্রশ্নে সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
তাঁদের যুক্তি হলো, ইউক্রেনকে এত বেশি অর্থ পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উচিত হবে না। কেননা সেই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু রিপাবলিকান শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই চান যে ইউক্রেনকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দেওয়া হোক। তাঁদের মধ্যে সিনেটের সংখ্যালঘু দলের নেতা মিচ ম্যাককনেলও রয়েছেন। এই বিভক্তি পার্টির মধ্যে ফাটল বাড়াচ্ছে।
রিপাবলিকানদের মধ্যে এই ফাটল অক্টোবর মাসে বড় করে সামনে আসতে শুরু করেছে। ফ্লোরিডার উগ্র ডানপন্থী কংগ্রেসম্যান ম্যাট গেইটজ সে সময় প্রতিনিধি সভার স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে জো বাইডেনের সঙ্গে গোপনে তিনি ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়ার চুক্তি করেছেন।
ম্যাকার্থি সেটি অস্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে গেইটজ ও আরও সাতজন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা সমর্থন দেওয়ায় স্পিকারের পদ থেকে ম্যাকার্থিকে সরে যেতে হয়।
নতুন স্পিকার কি সমঝোতার বিষয়টি এগিয়ে নেবেন?
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে মাইক জনসন প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার প্রশ্নে সমর্থন দেন। কিন্তু পরে তাঁর অবস্থান পরিবর্তিত হয়।
গত সপ্তাহে জনসন বলেন, তিনি এ ব্যাপারে ‘আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী’ যে কংগ্রেস ইসরায়েল ও ইউক্রেন—দুই দেশের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল অনুমোদন করবে। কিন্তু একই বিলে দুটি অগ্রাধিকার থাকা ঠিক নয় বলেও পরামর্শ দেন তিনি। ইয়াংয়ের চিঠির প্রতিক্রিয়ায় জনসন আবারও তাঁর দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ইউক্রেনকে কোনো সহযোগিতা দিতে হলে সেটা অবশ্যই বৃহত্তর নীতির সঙ্গে মিলতে হবে।
এ বছরের মধ্যে আরেকটি প্যাকেজ পাস করতে পারবে?
ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য অনেক বেশি তৈরি হওয়ায় তারা এখন একটা মীমাংসায় আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে অনেক বেশি অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। রিপাবলিকানদের অন্যতম নেতা ওকলাহোমার সিনেটর জেমস ল্যাঙ্কফোর্ড খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, আইনপ্রণেতাদের শেষ পর্যন্ত একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ল্যাঙ্কফোর্ড বলেন, ‘আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা, মানব পাচার বন্ধ এবং আইনের ফাঁকফোকর গলে অপব্যবহারের যে সুযোগ, তা বন্ধে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’
ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে কী ঘটবে?
ইয়াং তাঁর চিঠিতে এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন হীনবল হয়ে পড়বে। তাতে করে ইউক্রেনীয় বাহিনী এখন পর্যন্ত যতটা অর্জন করতে পেরেছে, তা তারা শুধু খোয়াবেই না, রুশ সেনাবাহিনীর বিজয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।’
ইয়াং সতর্ক করেন যে সে ধরনের পরিস্থিতিতে বড় পরিসরে আঞ্চলিক সংঘাত বেধে যেতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা জড়িয়ে পড়তে পারে। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিদেশে মার্কিন সেনাদের বিপদে ফেলতে পারে।
ইয়াং বলেন, ‘আমি অবশ্যই এ বিষয়ে জোর দিতে চাই যে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা করা এবং সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কংগ্রেস এ বিষয়ে এখন যে পথ বেছে নেবে, তা বহু বছরের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
জন ই গ্রেভি দ্য গার্ডিয়ানের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত