ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যে কী পরিস্থিতি হবে

গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের হামলা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ। বার্লিন, জার্মানি, ৫ অক্টোবরছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলে তেহরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের গতিপথ বদলের একটি সূচনাবিন্দু। ‘প্রতিরোধের অক্ষের’ বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরাসরি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় ইরান পাল্টা এই হামলা চালায়।

নেতানিয়াহু এই সংকল্পে অটল রয়েছেন যে তিনি ইরানের সঙ্গে সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনবেনই। এই সংঘাত যদি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয়ে বিশ্বের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে ফেলে, তারপরও নেতানিয়াহু এটাই চান।

বছরের পর বছর ধরে নেতানিয়াহু তাঁর এই লক্ষ্যপূরণে কাজ করে আসছেন। এক দশক ধরে তিনি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে উমেদারি করে যাচ্ছেন। এমনকি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথাও বলেছেন তিনি।

গাজা যুদ্ধের এক বছরের মাথায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং হিজবুল্লাহ ও হামাসের নেতাদের হত্যা করে নেতানিয়াহু একটা বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা করছেন।

গত মাসে লেবাননে পেজার ও ওয়াকিটকির নেটওয়ার্কে হামলা এবং বৈরুতে বিমান হামলা করে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল আঞ্চলিক উত্তেজনাকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে।

নেতানিয়াহু এটা ভেবে থাকতে পারেন যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই শুধু নতুন জীবন পাবে না, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের জন্য একটা নিরাপত্তাসৌধ নির্মাণের জন্য রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি সম্রাটের আসনও পাবেন। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্য ও গোটা বিশ্বের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থান অনন্য। এ অঞ্চলে জ্বালানির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগত তিনটি বাণিজ্যপথ অবস্থিত। হরমুজ প্রণালি, সুয়েজ খাল ও বাব এল-মান্দেব প্রণালি। এ তিনটি পথ ব্যবহার করে সমুদ্রপথে গোটা বিশ্বের তেল–বাণিজ্যের অর্ধেকটা সম্পন্ন হয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বড় কোনো যুদ্ধ বাধলে বিশ্বের তেলবাজারের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় হুমকি তৈরি করবে।

যদিও তেল আমদানির ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা উৎস রয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র অঞ্চল দিয়ে তেল আমদানি বন্ধ হলে কিংবা তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল সরবরাহের ব্যবস্থা ও দামের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। এর অভিঘাতে নিশ্চিত করেই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যদি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং তেল–বাণিজ্যের পথগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে মারাত্মক। ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, কাতারসহ অন্য যে দেশগুলোর অর্থনীতি পেট্রোলিয়াম পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভর করে, তারা সংকটে পড়বে।

বাহরাইনের দৃষ্টান্ত ধরা যাক। দেশটির জাতীয় বাজেটের ৬০ শতাংশ আসে হরমুজ প্রণালির হয়ে তেল রপ্তানির ওপর। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে ছোট অর্থনীতির এ দেশটির জন্য তা হবে মহাবিপর্যয়।

সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক। উপসাগরীয় বাণিজ্যপথগুলো দিয়ে প্রতিদিন ৬০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে দেশটি। তেল বিক্রি করে প্রতিবছর শত শত বিলিয়ন ডলার আয় আসে দেশটির।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করছে। আগামী কয়েক বছরে তারা তেল রপ্তানি দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। কাতার প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে। কুয়েত রপ্তানি করে ৬২ বিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম পণ্য। দেশটির আয়ের ৯০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। মিসরের সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর তারা ৯ বিলিয়নের বেশি রাজস্ব আয় করেছে।

গাজা যুদ্ধের কারণে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের এ তিনটি পথে বাধা তৈরি হওয়ায় এ দেশগুলো এমনিতেই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। আর যদি যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ার কারণে পথগুলো একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে হঠাৎ করেই যদি রপ্তানি আয়ে ধস নামে, তাহলে এ দেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার জন্য যে ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে হয়, সেটা কমিয়ে দিতে হবে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমের মতো এই অঞ্চলেও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।

এই পরিস্থিতি নির্দিষ্ট করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কেননা এ দেশগুলোর নাগরিকেরা অনেক বেশি ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল। একটা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ঘটলে এ দেশগুলোতে ভোগ্যপণ্যের মজুত কমে আসার সঙ্গে
সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ঘটাবে, যেটা শেষ পর্যন্ত ভারসাম্যটাকে বিপদে ফেলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের ১২টির চেয়ে বেশি দেশে মার্কিন সেনাদের কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। একটা বিস্তৃত যুদ্ধ হলে এসব ঘাঁটি আক্রান্ত হতে পারে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সংঘাতে নিয়ে আসতে পারে। ফলে আরও বেশি অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একক তেলনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের অর্থনীতিকে বহুমুখী করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেমন সৌদি আরব রূপকল্প–২০৩০ বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। এ জন্য তাদের ২৭০ বিলিয়ন বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। একটা যুদ্ধ হলে বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে পারে, যেটা অর্থনীতিকে শুকিয়ে মেরে ফেলবে।

এসব বাস্তবতা ইতিমধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠা একটি অঞ্চলকে অনিশ্চয়তার যুগে নিয়ে যাবে।

  • হুসেইন চোরখ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের নীতি–গবেষক

  • মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত