ইলন মাস্ক–আদানিদের উত্থান বলছে এখন নব্যসামন্তীয় পুঁজিবাদের কাল

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কছবি: রয়টার্স

অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাশিয়া ও চীনের মতো স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শাসনগুলোকে ধনিকতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। সেখানে প্রভাবশালী অলিগার্ক বা ধনকুবেররা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করতেন। রাশিয়ার পুতিন সরকারে ইউরি কোভালচুক, গেন্নাদি তিমশেঙ্কো ও রোতেনবার্গ ভাইদের স্পষ্ট প্রভাব ছিল। অন্যদিকে চীনে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ঝং শানশান ও মা হুয়াতেংয়ের মতো শতকোটিপতিদের বেড়ে ওঠায় সহায়তা করেছে।

কিন্তু আজ উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও ক্রমে এই ধনিকতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন প্রশাসন এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। ট্রাম্পের ‘বিলিয়নিয়ার বয়েজ ক্লাব’–এ ইলন মাস্ক, হাওয়ার্ড লুটনিক, বিবেক রামস্বামীসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। ইলন মাস্ককে (যাঁর সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার বা তার বেশি) নতুন একটি ‘সরকারি দক্ষতা বিভাগ’-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিভাগটি প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের ‘সরকারি অপচয়’ কমানো এবং ‘অতিরিক্ত’ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাতিল করার লক্ষ্যে কাজ করবে।

নরেন্দ্র মোদির সরকারের এই সময়ে ভারতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মোদি প্রশাসন মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি ও সাজ্জন জিন্দালের মতো কিছু ধনকুবেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর লক্ষ্য হলো ব্যবসাবান্ধব নীতি চালু করা এবং অর্থনীতিকে আরও উদারীকরণ করা। শুধু ভারত নয়, এমন ধনকুবেরদের প্রভাব ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, তুরস্কসহ অন্য অনেক উদার গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, ধনিকতন্ত্রের প্রতি এই বৈশ্বিক পরিবর্তন কীভাবে বোঝা যাবে? এখন ধনকুবেররা শুধু অর্থনীতির নয়, রাজনীতিতেও এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি অর্থনীতির একটি বড় পরিবর্তনের অংশ। আগে নব্য উদারবাদ, অর্থাৎ ‘মুক্তবাজার’-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হতো।

এখন আমরা নব্যসামন্ততন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। নব্যসামন্ততন্ত্র হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে চরম বৈষম্যের কারণে বিশালসংখ্যক সাধারণ মানুষ কেবল ধনীদেরই সেবা করে বেঁচে থাকে। একাডেমিক ব্যক্তিত্ব জোডি ডিন এটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘কয়েকজন বিলিয়নিয়ার সমান এক বিলিয়ন অনিশ্চিত শ্রমজীবী।’

আজকের দিনেও বুলেটগতিতে বৈশ্বিক অসাম্যের দ্রুত বৃদ্ধি নব্যসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ১৯৮০-এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে আয়বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে চলেছে। এ প্রবণতা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা প্রায় সব বড় শিল্পোন্নত দেশ ও উদীয়মান বাজারে দেখা গেছে। নব্যসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো বর্তমান ‘প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি’। এখানে অ্যাপল, গুগল, মেটা, উবার এবং এয়ারবিএনবির মতো অল্প কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানি অসাধারণ ধনী হয়ে উঠেছে।

এসব কোম্পানি তাদের মালিক ও শেয়ারহোল্ডারদের বিলিয়নিয়ারে পরিণত করেছে। তারা কম খরচে শ্রম, অস্থায়ী কর্মী ও সস্তা কারখানার ওপর নির্ভর করেছে। পাশাপাশি তারা সরকারের কাছ থেকে করছাড় ও বিনিয়োগের সুবিধা পেয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে আর কোম্পানিগুলো আরও ধনী হয়েছে। আজকের দিনে ধনী ব্যবসায়ীদের সরকারে জড়িত হওয়ার মূল কারণ হলো নিজেদের জন্য সুবিধাজনক কর ও বিনিয়োগনীতি নিশ্চিত করা এবং বিশাল মুনাফা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

ট্রাম্প, মাস্ক, আদানি বা বেরলুসকোনির মতো ব্যক্তিরা নিজেদের জনগণের নেতা হিসেবে দেখালেও তাঁদের নীতিগুলো মূলত করপোরেট লাভ বাড়ানো ও বাজারের দখল নেওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। নব্যসামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি নব্য উদারবাদ থেকে আলাদা। এখানে মুনাফা অর্জনের জন্য আরও বেশি চাপ দেওয়ার ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজন হয়। যেহেতু নব্যসামন্ততান্ত্রিকতাই আজকের বাস্তবতা এবং ধনকুবেরদের শাসন উত্তরোত্তর বাড়ছে, সেহেতু আমরা বুঝতে পারি, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলো ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে এগোচ্ছে।

  • ইলান কাপুর টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড আরবান চেঞ্জে ক্রিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত