একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটা সম্পাদনার জন্য জমা দেব, এই সময় খবর আসতে লাগল মৃত্যুর। রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে আসতে লাগল মৃত্যুর খবর। এরপর কী লিখব! আহমদ ছফা বলেছিলেন, একজন মানুষের অপমৃত্যুতেও আকাশ ভেঙে পড়া উচিত। আমাদের ছয়টা আকাশ ১৬ জুলাই ২০২৪ ভেঙে পড়েছে।
কেন এত হানাহানি? কেন এত মৃত্যু?
এটা সহজেই এড়ানো যেত। শুভবুদ্ধি প্রয়োগ করা উচিত ছিল, কিন্তু প্রয়োগ করা হলো দমন-নিপীড়নের পথ। অনেক দেরি হয়েছে। আর দেরি নয়। আজকেই যদি সরকার ঘোষণা দেয়, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হলো, কমিশন গঠন করে দেওয়া হলো। তাহলে আজই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মীমাংসার পথে দেরি হয়ে গেছে বলে কোনো কথা নেই, এখনই মীমাংসার সময়।
রক্তপাতের আগে ১৬ জুলাই সকালে যে লেখাটা লিখেছিলাম, তা আগে আপনাদের উদ্দেশে তুলে ধরি।
দুই.
কোটাবিরোধীরা কোটা তুলে দিতে বলছেন না, তাঁদের দাবি যৌক্তিক কোটা সংস্কার। সরকারও কোটাপ্রথার পক্ষে নয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল তো সরকারই করেছে। হাইকোর্টের আপিল বিভাগ এক মাসের জন্য হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছেন। তার মানে এই মুহূর্তে কোটা নেই। এরপর শুনানি হবে। বিচার বিভাগ তাঁদের সুচিন্তিত রায় দেবেন।
আমরা ধারণা, সবাই কোটাপদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চান। এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই তো হয়।
একটা পর্যবেক্ষণ বলি। দেশের ছাত্রসমাজের বেশির ভাগই কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে। তাদের একজনের ওপরে আক্রমণ হলে সেই ব্যথা সবার বুকেই বাজে। সরকার এবং সরকারি ছাত্রসংগঠন কেন নিজেদের অজনপ্রিয় করার পথ বেছে নিচ্ছে, এইটা আমাদের বুঝে আসে না।
২০১৮ সালের আন্দোলনের মুখে সব কোটা তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি। অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা দরকার আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮–এর দফা (৪)–এ বলা হয়েছে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না, অপর দিকে অনুচ্ছেদ ২৯–এর দফা (৩) (ক)-এ বলা হয়েছে, এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।
আমাদের সময়ে বুয়েটে ভর্তিপ্রক্রিয়ায় উপজাতিদের জন্য কোটা বরাদ্দ ছিল, নারীদের জন্য ছিল না। কিন্তু মেডিকেল কলেজে ভর্তিপ্রক্রিয়ায় নারী কোটা ছিল। এসব কোটা কোনো অসন্তোষ তৈরি করেনি। এ ধরনের কোটায় কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার যৌক্তিক একটা সংস্কার দরকার। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোনো জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর কারণে চাকরি পেতে দেখলে যদি সম্মান পান, সেই সুযোগ তিনি পেতে পারেন, কিন্তু এটাও একটা যৌক্তিক পরিমাণে হতে হবে। কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে কেউ একটু উফ্ বললেও আমার খুব খারাপ লাগে। আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখলে স্যালুট দিই, পায়ে ধরে সালাম করি। তাঁরা আমাদের দেশ দিয়েছেন। সুবেদার ওয়াহাব বীর বিক্রমকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর রণক্ষেত্রগুলো দেখতে গিয়েছিোম ১৯৯৫ সালে। তিনি যতবার আমাদের অফিসে আসতেন, আমি তাঁর ব্যাগ বহন করতাম।
শিক্ষার্থীদের মুখে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ শোনা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু নেতাদের ভুল কথা, ভুল আচরণ, দুর্নীতি, অগণতান্ত্রিক আচরণের ঢাল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারের প্রবণতার কারণে এটা আমাদের শুনতে হলো। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা রাজাকার নন, এটা বোঝাতেই তাঁরা বিক্ষোভে নেমেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুরের কথা শোনা যেতে পারে—‘১৪ জুলাই রাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার”, “চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার” এ ধরনের স্লোগান দেয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এই স্লোগান মোটেও নিজেদের “রাজাকার” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। বরং এটি এক ধরনের “আয়রনি”।’
মানে দায়টা নতুন প্রজন্মের নয়, দায়টা প্রবীণ প্রজন্মের। দয়া করে, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার সুযোগ দেবেন না। এই আবেদন সকল পক্ষের প্রতি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে একটুও চিড় ধরে, এমন কোনো কাজ কোনো পক্ষেরই করা উচিত হবে না। জেদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল আত্মঘাতী নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আক্রমণ করে, দমননীতি দিয়ে এত জনপ্রিয় একটা আন্দোলন দমন করা যাবে না। সাময়িকভাবে রাজপথ ফাঁকা করে দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ এবং তাঁদের পিঠে মারের দাগ থেকে যাবে। সরকার নিজে যেখানে কোটার সংস্কার চায়, সেখানে কেন তাঁরা জন-অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে না।
আরও একটা কথা নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এটা তাঁরা জানেন। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া। একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা সবাই নন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ফারুক-রশীদ-ডালিমরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের নাতি-নাতনিরা কোটার সুযোগ পেতে পারে কি?
আবার বাবা-দাদা মুসলিম লীগ করত, ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন— এমন বহু আছে। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু ছেলে বা মেয়ে পাকিস্তানবাদের ধ্বজাধারী হয়েছে, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে, এমনও আছে।
আজকের এই মুখোমুখি অবস্থান, মারামারি, রক্তক্ষরণ কিছুতেই কাম্য ছিল না। দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কোটাপ্রথার সংস্কার চান, মেরে–পিটিয়ে তাঁদের চুপ করানোর চেষ্টা সুফল দেবে না। এই চিন্তা আত্মধ্বংসী।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার, সমবেত হওয়ার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। আর লাঠিসোঁটা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মিছিলে মিছিলে হামলা করা বা রাতের বেলা হলের রুমে রুমে হামলা করা অগণতান্ত্রিক এবং অপরাধমূলক কাজ।
ছাত্রসংগঠনকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নামিয়ে দেওয়ায় দেশে মারাত্মক সংঘাতমূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জনগণের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। রক্ত ঝরছে। কার রক্ত ঝরছে, তা না দেখে দেখতে হবে আমাদের সন্তানেরা আক্রান্ত হচ্ছে, আহত হচ্ছে। তারাও আমাদের সন্তান, ওরাও আমাদের সন্তান।
এসবের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। তোমরাও সংস্কার চাও, আমরাও সংস্কার চাই, এসো একসঙ্গে সমস্যার সমাধান করি, সবাই খুশি হয়, এ রকম একটা যৌক্তিক সংস্কারে একমত হই—এ লাইন গ্রহণ করা হলে আজকে এই দুঃখজনক হানাহানি দেখতে হতো না। শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে রক্ত ঝরত না, এতগুলো প্রাণ ঝরত না।
সমঝোতার উদ্যোগ নিন। এখানে জয়-পরাজয়ের কোনো ব্যাপার নেই। সবার দাবি তো একই। আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই। সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা কেবল সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলেই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রকৃত সম্মান জানাতে পারি।
তিন.
এখন বারবার মনে পড়ছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদের কথা। কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। প্রথম আলো অনলাইনের খবর: সাঈদের বাড়িতে তখন শোকার্ত মানুষের ভিড়।
মা মনোয়ারা বেগম মাটি চাপড়ে আহাজারি করে বলছিলেন, ‘মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান? ও তো কাউকে মারতে যায় নাই। চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ? অই পুলিশ, তুই মোকে গুলি করিয়া মারলু না ক্যান? বাবাটাক না মারিয়া পঙ্গু করি থুইলেও তো দেখপের পানু হয়।’
মনোয়ারা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘সারাটা জেবন কষ্ট করনো। মজুর করিয়া একটা ছইলোক পড়াইনো। আশায় আছনু, বাবাটা (সাঈদ) চাকরি করলে শ্যাষ বয়সোত শান্তিমতো খামো। আশা-ভরসা সউগ শ্যাষ হয়া গেল। হামরা কেঙ্কা করি চলমো?’ (১৭ জুলাই, ২০২৪)
নিহত আবু সাঈদের পরিবার হতদরিদ্র। ৯ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন সাঈদ। তিনি রংপুরে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে চলতেন, বৃদ্ধ মা-বাবাও চালাতেন। তাঁর উদ্যোগে এলাকায় গড়ে উঠেছে, ‘বাবনপুর স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সদস্যরা মাসিক চাঁদা দিয়ে এলাকার গরিব-দুঃখী মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান।
আর কোনো মনোয়ারা বেগমের বুক যেন খালি না হয়।
খুব দেরি না করে কোটা সংস্কারের ঘোষণা দিন। কমিটি করে দিন। উত্তেজনার মুহূর্তে এতটুকুই বলি। এরপর আরেকটু ভালো সময়ে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, কেন মাত্র তিন হাজার পদের জন্য চার লাখ প্রার্থী হন্যে হয়ে গেল এবং কেন তরুণ-কিশোরেরা এত ক্ষুব্ধ, এত মরিয়া হলো?
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক