প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় নির্বাচনের ব্যয়ের বরাদ্দ না দেওয়ায় দেশটির গণতন্ত্র আবার হুমকির মুখে পড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার যদি সত্যি সত্যি রাজনৈতিক সংস্কারে আন্তরিক হয়ে থাকে, তাহলে ভোটারদের দাবি সরকারকে কানে নিতেই হবে।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় নির্বাচন কমিশন দেশটির সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে দিয়েছে, ৯ মার্চ স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় তহবিল না থাকায় তা তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২৮০ কোটি ডলার দরকার। বিক্রমাসিংহের সরকার সেই অর্থ ছাড় করতে রাজি না হওয়ায় কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য, ব্যালট পেপার ছাপানোর ও নির্বাচনকাজে ব্যবহার্য যানবাহনের জ্বালানির খরচ দিতেও অর্থ মন্ত্রণালয় অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করার খরচ জোগাতেও তারা অপারগতা প্রকাশ করেছে।
শ্রীলঙ্কার বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, চার বছর পর পর সেখানে স্থানীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। সর্বশেষ এই নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালে। সে হিসাবে ২০২২ সালে ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছর সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচন ২০২৩ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত বিলম্বিত হবে। নির্বাচন পেছানো দেশবাসীকে সংক্ষুব্ধ করে এবং রাজধানী কলম্বোতে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। বিরোধী দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির কয়েক হাজার সমর্থক রাস্তায় মিছিল করতে করতে নেমে আসেন এবং প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের থামাতে পুলিশ জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে, যাতে অন্তত ১৫ জন আহত হন। ভোট পেছাতে এটিই যে বিক্রমাসিংহের প্রথম চেষ্টা ছিল, তা মোটেও নয়। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তারা নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য অন্তত ২০টি আবেদন পেয়েছে।
আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। সেটি দেশকে আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
জেলা সচিবদের ভোটের কাগজপত্র জমা না নেওয়ার জন্য সরকারের তরফ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। জনপ্রশাসনের পাঠানো ওই চিঠি পরে জনগণের চাপে প্রত্যাহার করা হয়। বিক্রমাসিংহে বারবার বলে আসছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর্থিক সংগতি নেই। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচন কমিশনের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনই এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
তবে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান নিমল পুঞ্ছিহিওয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনজন নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার আইন অনুযায়ী, তিনজন কমিশনার সম্মতি দিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনগত বাধা থাকে না।
নির্বাচন পেছানোর ঘটনা কারও কাছে অবাক করার বিষয় ছিল না। কারণ, এই ভোটকে বিক্রমাসিংহের সরকারের গ্রহণযোগ্যতা–সংক্রান্ত বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ধস নামার জেরে শুরু হওয়া বিক্ষোভে রাজাপক্ষে সরকারের পতনের পর এটিই শ্রীলঙ্কার জনগণের সামনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পতিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার উত্তরসূরি বিক্রমাসিংহের সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভোটারদের কাছে চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হবেন। গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিক্রমাসিংহেকে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি, করেছে দেশটির পার্লামেন্ট।
অন্য সবার মতো বিক্রমাসিংহে নিজেও হয়তো জানেন, দেশের মানুষের কাছে তিনি খুবই অজনপ্রিয়। ছয়বার তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। রাজাপক্ষে পরিবারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং এই পরিবারের সমর্থন নিয়েই তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এ কারণে অনেক শ্রীলঙ্কান মনে করেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংকট উত্তরণের ঋণ পাওয়াসহ বড় কোনো আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নৈতিক অধিকার বিক্রমাসিংহের নেই।
এটি প্রশ্নাতীত যে স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি হলে কিংবা ভোটে অনিয়ম হলে আইএমএফের সঙ্গে একটি অনুকূল সমঝোতায় পৌঁছানো প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহের জন্য দুরূহ হবে। এ কারণেই তিনি যত দিন সম্ভব নির্বাচন পিছিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়েছেন।
একদিকে দেশটিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জরুরি, অন্যদিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ ইস্যুও রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের আগে নির্বাচন দিতে না চাওয়া ভয়ানক নজির সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। সেটি দেশকে আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
বছরের পর বছর দুর্নীতি ও অপশাসনের পর এটি স্পষ্ট যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থপূর্ণ পরিবর্তন চায় জনগণ। তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং সেই ইতিবাচক পরিবর্তন তাদের প্রাপ্য।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ক্রিস ফিটজেরাল্ড মেলবোর্নভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সংবাদদাতা