নিরঙ্কুশ শেখ হাসিনা ও বাইডেনের চাপ প্রয়োগের পররাষ্ট্রনীতির পরাজয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাফাইল ছবি: পিআইডি

১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবার হত্যার পর, ছয় বছরের নির্বাসন শেষে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলার রক্তভেজা মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা।

ছোট বোন শেখ রেহানার ভাষায়, ‘তিনি রাষ্ট্রনায়ক ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতটা সফল, তা ইতিহাস বিচার করবে। কিন্তু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, যিনি জগৎ-সংসার ও স্বামী-পুত্র-কন্যার কথা চিন্তা না করে পুরোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন পিতা-মাতার স্বপ্ন পূরণে, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে।’

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের কারফিউ গণতন্ত্র চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্ল্যাসিফায়েড তথ্য থেকে এটা আমরা ধরে নিতে পারি, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জেনারেল জিয়া জড়িত ছিলেন।

এর পর থেকে মোশতাককে সামনে রেখে উপসেনাপ্রধান হিসেবে কলকাঠি নাড়লেও ৭ নভেম্বর তিনি কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেন এবং পরবর্তীকালে তাহেরকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেনাবাহিনীতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুন

এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রহসনমূলক ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মাধ্যমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন এবং গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে অর্থ ও অস্ত্রের ব্যবহারে স্বাধীনতাবিরোধী ও দলছুটদের নিয়ে প্রথমে জাগদল ও পরে বিএনপি গঠন করেন।

জেনারেল জিয়া যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ পাকিস্তানপন্থী দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘোরাতে থাকেন।

ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনামলে হাজার হাজার সেনাসদস্যকে প্রহসনের বিচারে হত্যা করা হয়। এ সময়ে অন্তত ১৯টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে অনুরূপ একটি অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন জেনারেল জিয়া।

তখন মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করে ও তড়িঘড়ি বিচারে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়ে এবং জেনারেল শওকতসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে সরিয়ে দিয়ে, এক ঢিলে বহু পাখি মেরে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

বিবিসি নিউজ বাংলাদেশের রাজনীতিকে আখ্যায়িত করে ‘ওয়ান ওমেন শো’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মন্তব্য প্রতিবেদনে উঠে আসে চরম বাস্তবতা, ‘নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথে শেখ হাসিনা, পরাজিত হলো জো বাইডেনের চাপ প্রয়োগমূলক পররাষ্ট্রনীতি।’ নির্বাচনের দুই দিন আগেই নিউইয়র্ক টাইমস সরাসরি জানিয়ে দিল, ‘বিএনপির রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। তারা আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।’

মুখে ধর্মের কথা বলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করলেও তাঁর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত অনাচারের কাহিনি সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অজনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। পটুয়া কামরুল হাসান তাঁকে আখ্যায়িত করেন ‘বিশ্ববেহায়া’ হিসেবে।

তারপরও এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকেন তদানীন্তন ভারত সরকারের ‘ওভার্ট-কোভার্ট’ পররাষ্ট্রনীতির কারণে। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁকে ঘিরে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়, আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে দুই ভাগ করে এরশাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা হয়। একইভাবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সে রাখতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে তরুণদের নিয়ে ‘জাসদ’ সৃষ্টি করা হয়। ২০০৭–৮ সালে পশ্চিমাদের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র প্রতিও প্রতেবেশীদের সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে।

তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার কঠোর অবস্থানের কারণে দিল্লি শেখ হাসিনার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে আসছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক ‘ওয়ান প্লাস ওয়ান’ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতি চাপ প্রয়োগমূলক ভূমিকারও সরাসরি বিরোধিতা করে তারা।

এদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দক্ষিণপন্থীরা বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে এবং ‘হাসিনা-খালেদা’র সমান্তরাল ব্র্যান্ডিং তৈরি করতে থাকে।

এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে দক্ষিণপন্থী স্টাবলিশমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার অবশ্যম্ভাবী বিজয় ঠেকিয়ে দেওয়ার নীলনকশা প্রণয়ন করেন জেনারেল নুরুদ্দীন খান। এবারও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপি জোটের পক্ষে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও বিচ্যুত রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে প্রার্থী বাছাই করে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামায়।

এমনকি তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ‘আসন সমন্বয়’-এর বন্দোবস্ত পর্যন্ত করে দেয়। ১৯৯১ সালের এ নির্বাচনে সব পূর্বাভাস ও জরিপকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে জামায়াতের সমর্থনে বেগম জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয়।

এর পর থেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে’—দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চালু করে দেওয়া হয় ‘দুই বেগমের লড়াই’!

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেন এবং রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় খালেদা জিয়ার পতন ঘটান। একই বছর ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং জাতীয় পার্টির একাংশের সমর্থনে সরকার গঠন করে।

আওয়ামী লীগ মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও গ্যাস বিক্রির টাকার খেলায় সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আবারও খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসে। এবার ‘হাওয়া ভবন’ স্থাপন করে ব্যাপক দুর্নীতির জাল বিস্তার করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাটিও নিজেদের পক্ষে নিয়ে নেয় বিএনপি-জামায়াত।

আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের সুযোগে তৃতীয় শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের ইমার্জেন্সি সরকার। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সে সময়কার জনপ্রত্যাখ্যাত বিএনপিকে কবর দিয়ে এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে মার্কিন মদদপুষ্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।

কিন্তু গণরোষের মুখে এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং সেনা-সমর্থিত এ সরকার দুই বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে নিরাপদে বিদায় নেয়। ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু এ নির্বাচনে আওয়ামী জোট ৮৭ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয় এবং তাদের প্রাপ্ত ভোট ৪৭ শতাংশে দাঁড়ায়।

এবারও বিএনপি-জামায়াত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। সরকার গঠনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠিত হয় নৃশংসতম বিডিআর হত্যাকাণ্ড। এ মহাদুর্যোগ কাটিয়ে শেখ হাসিনা একই সঙ্গে চালাতে থাকেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতি জোরদারের প্রক্রিয়া। বাংলার মাটিতে কার্যকর হয় জাতির জনককে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়।

সব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নিজ অর্থায়নে নির্মিত হয় পদ্মা সেতু। বাজেটের আকার ৬০ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। বাংলাদেশ পরিণত হয় মধ্যম আয়ের দেশে।

বিএনপি-জামায়াত ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে চরম নাশকতার পথ বেছে নেয়। তারপরও শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারেনি। ২০১৮ সালে তারা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তবে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়িয়ে নির্বাচনটিকে বেশ খানিকটা বিতর্কিত করে তুলতে সক্ষম হয়।

এরই মধ্যে আসে কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়ে অর্থনৈতিক চাপ। এবার বাংলাদেশ পরিণত হয় মার্কিন ভূরাজনৈতিক টার্গেটে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তত দিনে শেখ হাসিনার অ্যাপ্রুভাল রেটিং ৭০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

সব বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা এগোতে থাকেন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে। বিএনপি ভোট বর্জন করায় তিনি নিজ দলের একাধিক প্রার্থীকে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেন। জমে উঠে ভোটের মাঠ। রণে ভঙ্গ দেয় পশ্চিমারা।

বিবিসি নিউজ বাংলাদেশের রাজনীতিকে আখ্যায়িত করে ‘ওয়ান ওমেন শো’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মন্তব্য প্রতিবেদনে উঠে আসে চরম বাস্তবতা, ‘নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথে শেখ হাসিনা, পরাজিত হলো জো বাইডেনের চাপ প্রয়োগমূলক পররাষ্ট্রনীতি।’

নির্বাচনের দুই দিন আগেই নিউইয়র্ক টাইমস সরাসরি জানিয়ে দিল, ‘বিএনপির রাজনীতিকে নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। তারা আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।’ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছে, ‘শেখ হাসিনা ভারত ও চীনকে একইসঙ্গে পাশে নিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন।’

নিরঙ্কুশ শেখ হাসিনা! বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭০ সালে আরেকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। যখন মাওবাদ-লেনিনবাদকে ডিঙিয়ে বাংলার মাটিতে মুজিববাদ নিরঙ্কুশ হয়ে উঠেছিল এবং মাওলানা ভাসানীসহ অপরাপর সব জাতীয় নেতাকে পেছনে ফেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের একক নেতা। বাংলাদেশ পায় স্বাধীনতা! সে সময় বঙ্গবন্ধুর বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘চাটার দল’! শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জও অভিন্ন।

(ঈষৎ সংশোধিত)

  • মোজাম্মেল বাবু সাংবাদিক ও কলাম লেখক।