সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ নিয়ে যাত্রা শুরু হোক

৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয় কী হবে, তা নিয়ে লিখেছেন সঞ্জীব দ্রং

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানফাইল ছবি

৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং দিবসটি পালনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়। তার পর থেকে গত তিন দশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

এর মধ্যে ২০০০ সালে জাতিসংঘে আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার নিয়োগ, ২০০৫-২০১৪ সালের সময়কালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক হিসেবে পালন, ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র গ্রহণ ও আদিবাসী অধিকার-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা প্রবর্তন, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ (লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড) স্লোগান নিয়ে যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।

দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও আদিবাসী মানুষের মুক্তি মেলা তো দূরের কথা, তাদের ওপর শোষণ ও বঞ্চনার অবসান হয়নি। দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

  • দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

  • আমরা আশা করব, নতুন সরকার দেশের আদিবাসীসহ সব নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানবিক ও সংবেদনশীল আচরণ করবে।

  • সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ জরুরি। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাখা দরকার।

এই বছর আদিবাসী দিবসের মূল সুর হলো ‘প্রোটেকটিং দ্য রাইটস অব ইনডিজিনাস পিপলস ইন ভলান্টারি আইসোলেশন অ্যান্ড ইনিশিয়াল কন্টাক্ট’। এই পৃথিবীতে এখনো অনেক আদিবাসী সমাজ আছে, যেখানে তারা নিজেদের স্বকীয়তা, আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কোনোভাবেই জোর করে তাদের জীবনধারা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

এই দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘এ বছরের থিম আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আদিবাসীদের ওপর অযাচিত কোনো অধিকার বা উন্নয়ন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার ওপর জোরপূর্বক আগ্রাসন চলবে না।’ তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আসুন, আমরা আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করি, যাতে তারা শান্তি ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে।’

আদিবাসী দিবসের আগের রাতে ৮ আগস্ট দেশে নতুন সরকার যাত্রা শুরু করেছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। শত শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এক অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আকাশসম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই সরকার নবযাত্রা শুরু করেছে। আমরা আশা করব, নতুন সরকার দেশের আদিবাসীসহ সব নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানবিক ও সংবেদনশীল আচরণ করবে।

সবার মতো আমরাও রাষ্ট্র সংস্কার চাই। এখনই সময়। এই রাষ্ট্রকে হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক, যেখানে কেউ অধিকার থেকে, অংশগ্রহণ ও উন্নয়নের ধারা থেকে বাদ পড়বে না। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদকে এই রাষ্ট্র স্বীকৃতি শুধু নয়, উদ্‌যাপন করবে। এখানে সমাজের সবচেয়ে গরিব অসহায় ও দুর্বল, পিছিয়ে পড়া, যারা দলিত, শোষিত ও বঞ্চিত, শ্রমজীবী মানুষ, অসহায় গরিব কৃষক, হরিজন, পোশাককর্মী, পথশিশু, রিকশাচালক, চা-বাগানের শ্রমিক, আদিবাসী—এসব মানুষ রাষ্ট্রের কাছে অগ্রাধিকার পাবে।

আশা করি, এই রাষ্ট্র লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নকে বুঝতে সক্ষম হবে এবং তাঁদের হতাশা দূর করার জন্য পদক্ষেপ নেবে। কেন আমাদের এত তরুণ দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান? কেন তাঁরা ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হবেন জেনেও জীবনের ঝুঁকি নেন বা থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে মৃত্যুকে বরণ করেন? এই নতুন রাষ্ট্র ভুল হলে তা স্বীকার করবে এবং পরে আত্ম-অনুসন্ধানী, বিনয়ী ও উদার হবে।

মহাশ্বেতা দেবী তাঁর গঙ্গা-যমুনা-ডুলং-চাকা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা মূলস্রোত-চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। সরকার আদি-তফসিলীদের জন্য এত রকম কাগুজে ব্যবস্থা এই জন্য করেছেন যে, সরকার জানে ওদেরকে পশ্চাৎপদ করেই রাখা হয়েছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, জমির হক, বনজ সম্পদে অধিকার, জীবনের সব ক্ষেত্রেই ওরা বঞ্চিত। এই জন্য এত আইন ও স্কিম। কেন্দ্র ও রাজ্য—সব মিলিয়েই আমি ‘‘সরকার” শব্দটি ব্যবহার করলাম। আদিবাসী সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ সংগঠন, সবকিছুর অস্তিত্বই বিপন্ন এবং এটাই ভারতের আদিবাসীর ইতিহাস, যে ইতিহাস মানবসৃষ্ট। ওরা মূলস্রোত থেকে দূরে আছে। মূলস্রোতে ওদেরকে ভারতবর্ষ শব্দটির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে কোনো দিন ভেবেছে কি না, আত্মজিজ্ঞাসা করতে অনুরোধ করি। একটি প্রশ্ন বহুকাল ধরে করে আসছি।

আইটিডিপি এলাকায় এবং আদিবাসীদের জন্য সমুদ্রসমান টাকা আসছে, খরচ হচ্ছে। আইটিডিপি এলাকা, আদিবাসী জীবন, মূলত আদিবাসী প্রধান এলাকা (সিংভূম, সাঁওতাল পরগনা, রাঁচি, পালামৌ, হাজারিবাগ); এসব জায়গায় ও আদিবাসী জীবনে ওই বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রতিফলন নেই কেন?

কেন তারা ভূমিহীন, দেশান্তরী মজুর, শিক্ষায় এত পেছনে, তৃষ্ণার জলে, সেচের জলে বঞ্চিত? ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্ত আদিবাসী কতজন আছেন? এসব টাকা কোথায় যাচ্ছে? সরকারি নিয়মমতে, যেসব বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলেছি, তার বাইরে সেচ-পূর্ত-কৃষি-শিক্ষা, এমন প্রতি দপ্তরের জন্য ৪% টাকা আদিবাসী উন্নয়নে খরচ হওয়ার কথা।’

আজ আদিবাসী দিবসে দাবি জানাব, দেশে একটি আদিবাসী নীতি বা ‘ইনডিজিনাস পলিসি’ থাকা দরকার। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ জরুরি। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাখা দরকার।

আসুন, আমরা নবরূপে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদকে উদ্‌যাপন করি। নিশ্চয় ভবিষ্যতে আমরা আমাদের দেশে আদিবাসী-বাঙালি পরিচয়কে ছাপিয়ে সবাই মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠতে পারব। 

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী