এই সরকার প্রচলিত অর্থে ‘রাজনৈতিক’ সরকার নয়। কিন্তু রাজনৈতিক ওলট-পালটই এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা সরকারের পতন—এগুলো সবই রাজনৈতিক অ্যাক্ট।
আবার দায়িত্ব নেওয়ার পর মূলত রাজনৈতিক বিষয়গুলোকেই সামাল দিতে হচ্ছে সরকারকে। পতিত শক্তির ফিরে আসার ষড়যন্ত্র ঠেকানো, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা বিভিন্ন গণ-আকাঙ্ক্ষা পূরণ, ভিন্নমত ও পথের স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় শক্তি ও গোষ্ঠীগুলোকে আস্থায় রাখা এবং রাজনৈতিক নানা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া—সবই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এত সব ‘রাজনৈতিক’ দায়িত্ব পালনই সম্ভবত ‘অরাজনৈতিক’ অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক শক্তির জায়গাটিও অনেক বড়। ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান একটি স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সেই অর্থে এটা জনগণের ইচ্ছার সরকার। দেশের সব রাজনৈতিক দল জন-ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে এই সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও সমর্থন জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবেও এই সরকার এরই মধ্যে তার পক্ষে সব ধরনের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে সরকারপ্রধান ড. ইউনূস তাঁর সরকারের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের অবস্থান কী, তা অনেকটাই পরিষ্কার করতে পেরেছেন। অর্থনৈতিক সাহায্য–সহযোগিতারও ভালো প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এগুলো সবই সরকারের শক্ত ভিত্তিকে নির্দেশ করে। যে ভারত বাংলাদেশের পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারাও সামনে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটবে।
১৫ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা একটি স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করার পথটি ছিল ভয়াবহ ও রক্তাক্ত। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে কার্যত তিন দিন কোনো সরকার ছিল না। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। দেশে পুলিশ বলে কিছু ছিল না। অন্যদিকে প্রশাসনজুড়ে আছেন পতিত সরকারের অনুগ্রহ পাওয়া দলীয় ক্যাডারের মতো কর্মকর্তারা। দেশের এমনই এক পরিস্থিতিতে এই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। কঠিন সময়ে কঠিন কাজের দায় নিয়ে তারা ক্ষমতায় বসেছে।
সরকার গঠনের পর সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরো শক্তিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এই সুযোগে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে মাঠে নামে এবং সেই তৎপরতা এখনো চলছে। ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। নানা পথ ও মতের এই ছাত্র-জনতা, তাদের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর নিজ নিজ চাওয়া-পাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই চাওয়ার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে অনেক বৈপরীত্য আছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বা ভারসাম্য রক্ষার কাজটি সহজ নয়।
সরকারের উপদেষ্টারা নানা বিষয়ে কথা বলেন। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই বিষয়ে একজনের কথার স্পিরিটের সঙ্গে অন্যজনের মিল নেই। বোঝা যায়, সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না থাকায় উপদেষ্টারা নিজেদের অবস্থান থেকে কথা বলেন। অন্যদিকে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পরে তা বাতিল করে দেওয়ার যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক; এগুলো কি সরকারের সামগ্রিক নীতিগত সিদ্ধান্তে হচ্ছে, নাকি উপদেষ্টারা নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন?
আগেই বলেছি, কঠিন কাজ ও কঠিন দায় নিয়ে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এ জন্য সরকারের একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দরকার। সেখানেই কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে এখনো দুর্বল ও এলোমেলো মনে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ছে। এই সুযোগে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে, যা নিয়ে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্বস্তি বাড়ছে।
জন-ইচ্ছার সরকারের জনগণের শক্তির ওপর ভর করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার, সেখানে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর বিপদ হচ্ছে সাধারণভাবে যদি এই ধারণা জন্ম নেয় যে সরকার দুর্বল বা ভয় পায়, তাহলে স্বার্থান্বেষীরা সেই সুযোগ নেওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়বে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে অনেক কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে সরকার শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না।
বলা যায়, সরকার তার দুর্বলতার প্রথম প্রকাশ ঘটিয়েছে এইচএসসির বাকি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। কিছু শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা বাতিলের জন্য চাপ দিলে তাৎক্ষণিকভাবেই পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হয়। একই ঘটনা ঘটেছে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন-পরিমার্জনের জন্য গঠিত কমিটির ক্ষেত্রে। কোনো একটি মহল থেকে দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠল আর পুরো কমিটিই বাতিল করে দেওয়া হলো! এসব ঘটনা সরকারের দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।
কোনো দাবি বা চাপ মোকাবিলায় যে কৌশল নিতে হয়, চাপের মুখে কোনো অন্যায্য দাবি যে মেনে নেওয়া যায় না বা এর পরিণতি কী হতে পারে, সেই বিবেচনাবোধ অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে না। সেদিন দেখলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি (২০১৯-২০) পরীক্ষা না নিয়ে অটো পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অফিস ঘেরাও করেছেন।
মাজার, দরগা ও খানকায় হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সরকার এগুলো ঠেকাতে পারছে না। বিষয়টিকে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতার অভাব হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এখানে সরকার তার জোরালো রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে পারছে না। সেই সুযোগে একটি মহল এই অপকর্ম করেই যাচ্ছে।
সরকারের উপদেষ্টারা নানা বিষয়ে কথা বলেন। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই বিষয়ে একজনের কথার স্পিরিটের সঙ্গে অন্যজনের মিল নেই। বোঝা যায়, সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না থাকায় উপদেষ্টারা নিজেদের অবস্থান থেকে কথা বলেন। অন্যদিকে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পরে তা বাতিল করে দেওয়ার যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক; এগুলো কি সরকারের সামগ্রিক নীতিগত সিদ্ধান্তে হচ্ছে, নাকি উপদেষ্টারা নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন?
এই সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া অনেক। কিছু চাওয়া স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তারা আর আগের রাজনীতিতে ফিরে যেতে চায় না। কোনো সরকার যেন ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সেই নিশ্চয়তা চায়। তারা ভোট দিতে চায়, ভোট ডাকাতি বা কারচুপি দেখতে চায় না। রাজনীতির নামে দুর্নীতি, লুটপাট ও সম্পদ পাচার দেখতে চায় না, সুশাসন চায়; দলীয় ক্যাডারদের প্রশাসন দেখতে চায় না। ন্যায়বিচার পেতে চায়, বিচার বিভাগে রাজনীতিকীকরণ দেখতে চায় না। তারা চায় বর্তমান সরকার এ জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করুক। সরকার সেই উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছে।
একটি দলীয় সরকারের চেয়েও বেশি রাজনৈতিক কাজ এই অন্তর্বর্তী সরকারকে করতে হচ্ছে। এসব রাজনৈতিক কাজ বাস্তবায়নে সরকারে ‘পলিটিক্যাল মাইন্ড’ বা ‘রাজনৈতিক মন’-এর ঘাটতি টের পাওয়া যাচ্ছে। এখন যে সমস্যাগুলো সরকার সামাল দিতে পারছে না, ‘রাজনৈতিক মন’ দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে হয়তো সেই কাজ সহজ হতো। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, আগ-পিছ ও সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনার কাজটি ভালোভাবে করা যেত। সরকারকে কোনো অবস্থান নিতে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হতো না, সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাতিল করতে হতো না।
দৈনন্দিন সরকার পরিচালনার বাইরে জন-ইচ্ছা অনুযায়ী অনেক সংস্কারের কাজ এই সরকারকে করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই কাজ সারতে হবে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে। অথচ এই সরকারের আকার রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অনেক ছোট। এমন একটি ছোট আকারের সরকার দিয়ে এত কাজ করতে হলে যে দক্ষতা ও গতিশীলতা দরকার, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি?
সরকারে থাকলে অনেক চাপ নিতে হয়, নিতে পারতে হয়। এই সরকারে অনেক অ্যাকটিভিস্ট বা অধিকারকর্মী আছেন, যাঁদের চাপ দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু চাপ নেওয়ার শক্তি তাঁদের কতটা আছে? এসব ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের আকার কিছুটা বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে। সেখানে দক্ষ, কর্মক্ষম ও রাজনৈতিক ‘মনওয়ালা’ লোকদের যুক্ত করতে হবে।
‘বাড়তি কথা ও কাজ বিপদ ডাকিয়া আনে’—এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। এই সরকারকে বাড়তি অনেক কাজ করতে হবে, কিন্তু বিপদ ডেকে আনা যাবে না। তবে কথা কম বলতে তো সমস্যা নেই। কোনো বিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান কী, সে ব্যাপারে পরিষ্কার না হয়ে উপদেষ্টাদের কথা না বলাই ভালো।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক