স্পষ্টতই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তারা বিরক্ত। ডেঙ্গু রোগীর ঢেউ সামাল দেওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। ঢাকার গেটে তালা লাগাতে বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তারা। এ বছর ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৫। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪ হাজার ৯৭৬ এবং ঢাকার বাইরে ৯৮ হাজার ৮১৯ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৪৬ জন। কর্তারা হয়তো মনে করছেন, বাইরের রোগীর জন্য ঢাকা নিষিদ্ধ করতে পারলে ঢাকায় মৃত্যুর সংখ্যায় লাগাম টানা যাবে।
এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, পরিস্থিতি এখন আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এই মাসের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস উদ্বেগ জানান, ডেঙ্গু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ ফেলেছে।
অর্থাৎ গোটা চিকিৎসাব্যবস্থা ডেঙ্গু সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালের আগস্টে একই সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। খুব দ্রুত বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল সংস্থাটি। তাদের পরামর্শ ছিল কালক্ষেপণ না করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য অবিলম্বে সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ে ফাটকাবাজি চলছে
বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় স্যালাইন এখন ‘আউট অব মার্কেট’। ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোয় সাত মাসের বেশি সময় ধরে চাহিদার তুলনায় খুব অল্প পরিমাণ স্যালাইন দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল। কিছু স্যালাইন নাকি একেবারেই দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ওষুধের ব্যবসায়ীরা বা মজুতদার বা প্রস্তুতকারীরা এটার সুযোগ নিচ্ছেন।
কুড়িগ্রামে কথা বলে জানা গেল, সেখানে সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর ৬ হাজার ৫০০ ব্যাগ চাহিদার বিপরীতে ডিএনএস স্যালাইন গেছে মাত্র ৩০০ ব্যাগ। নরমাল স্যালাইন ৫ হাজারের বিপরীতে ৫০০, হার্টম্যান সলিউশন ৫ হাজারের বিপরীতে ৩ হাজার ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে দুই ধাপে পাওয়া স্যালাইনের মধ্যে ডিএ স্যালাইন পাওয়া যায়নি। এ কারণে বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরে থেকে এই স্যালাইন কিনতে বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ ছবি শুধু কুড়িগ্রামের নয়; ঢাকাসহ জেলা শহরের অনেক ক্লিনিকে খাতা–কলমে আইসিইউ থাকলেও বাস্তবে নেই। সরকার মুখে বলছে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই, আবার আমদানিও করছে। এ পর্যন্ত তিন লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানি করা হয়েছে। সামনে আরও করতে হবে।
মশা মারুন, কিন্তু রোগীও বাঁচান
আমরা জানি, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু ঠেকানো যাবে না। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধের সেটাই হচ্ছে প্রধানতম পদক্ষেপ। নানা দপ্তর, সংস্থা ও নাগরিকদের সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সেটা হওয়ার নয়। সেটা ঘটানোর জন্য কি কোনো কর্মকৌশল বা পরিকল্পনা আছে? এর আগে আক্রান্ত রোগীদের পছন্দের শহরে পছন্দের হাসপাতালে আর চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পথে ব্যারিকেড দেবেন না।
মানুষ জানে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেক হিসাব কাজির খাতায় থাকে, বাস্তবের গোয়ালে নয়। অধিদপ্তরের কথায় আস্থা রেখে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে ছয় বছরের ফুটফুটে মেয়ে তমা। অধিদপ্তর ঘোষণা দিয়েছিল, সব উপজেলা-জেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনাম বা সাপে কাটার টিকা আছে। সেই বিশ্বাসে তমাকে সাপে কাটার পর প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে অ্যান্টিভেনাম না থাকায় চিকিৎসকেরা তাকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে রেফার করলে সেখানেও ওষুধ না থাকায় তাঁরা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়। এটা ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। দেশের মানুষের প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা থাকলে এখনই তমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসুন।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক