রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প টেকসই হয়নি কেন

‘১ হাজার টাকার চামড়া ৫০ টাকায় কিনে যদি রপ্তানি–সফল হওয়া যেত, তাহলে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের গত কয়েক বছরে এভাবে ধসে পড়ার কোনো কারণ ছিল না।’
ফাইল ছবি

১৯৫১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান সরকার গেজেট ঘোষণা দিয়ে ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপন করে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে চামড়াশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পোশাকশিল্পের ৮৫ শতাংশ রপ্তানিনির্ভরতার বিপরীতে দেশের বাণিজ্য বহুমুখীকরণে এখনো খাতটি সম্ভাবনাময়।

১৯৯০ সালপরবর্তী সময়ে ওয়েট ব্লু উৎপাদনের সীমিত পরিসর পেরিয়ে ক্রাসড ও ফিনিশড লেদার, জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চামড়া খাতের রপ্তানিতে পণ্যবৈচিত্র্য এসেছে। ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় সোয়া এক বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অদূরদর্শিতার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমতে কমতে ৭৯৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। গত অর্থবছরে আবারও তা এক বিলিয়নে পৌঁছেছে।

২০০৩-০৫ সময়ে বিএনপি সরকার সাভারে কেন্দ্রীয় শোধনাগার বা সিইটিপিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ ও রাস্তাঘাট তৈরি করে হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ট্যানারিগুলো একত্র করে একটি পরিবেশসম্মত আধুনিক চামড়াশিল্প গড়ার উদ্যোগ নেয়। ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পে ট্যানারি ও কারখানা স্থাপনের জন্য ২০৫টি প্লট তৈরি করে ১৫৫টি শিল্প ইউনিটকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে ট্যানারির মালিকদের সিইটিপি নির্মাণের কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে সরকারের অর্থায়নে সিইটিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় এবং প্রকল্প ব্যয় সংশোধনপূর্বক ৫৪৫ কোটি টাকা ধার্য করে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তারও প্রায় ১৩ বছর গেল, কাজটি আজও পুরোপুরি শেষ হয়নি, কিন্তু বাজেট এক হাজার কোটি ছাড়িয়েছে।

পরবর্তী সময়ে সিইটিপি প্রকল্পে তিনটি কম্পোনেন্ট সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, স্লুয়েজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যুক্ত করে ট্যানারির মালিকদের ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণসহ মোট প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সিইটিপি নির্মাণকাজের সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের জন্য বুয়েটের বিআরটিসিকে নিযুক্ত করা হয়।

প্রকল্পের চতুর্থ সংশোধনীতে এসপিজিএস কম্পোনেন্টটি বাদ দিয়ে প্রাক্কলিত ব্যয় সামান্য কমিয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা এবং সময় জুন, ২০২১ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

কিন্তু চীনা ঠিকাদার কোম্পানিটি সময়মতো কাজ সম্পন্ন করেনি। নানা অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করেছে। ফলে এ কাজের জন্য তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে সিইটিপির মাধ্যমে পানি, লবণ, স্লাজ, কেমিক্যালস—কোনোটিই ঠিকমতো পরিশোধন হচ্ছে না। কোম্পানিটি ছয় মাস-এক বছর করে আনুমানিক ১২ বার সময় বৃদ্ধি করেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), সরকারের একাধিক মন্ত্রী, ট্যানারির মালিক, চীনা ঠিকাদার, বুয়েট বিআরটিসি—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা চামড়াশিল্পে এসে ব্যর্থ হয়েছে। চামড়াশিল্প আমাদের সক্ষমতার ক্ষত দেখিয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা, ভুল পরিকল্পনা, অদূরদর্শিতাসহ বাস্তবায়নে শোচনীয় ব্যর্থতার লজ্জাজনক উদাহরণ তৈরি করেছে!

১ হাজার টাকার চামড়া ৫০ টাকায় কিনে যদি রপ্তানি–সফল হওয়া যেত, তাহলে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের গত কয়েক বছরে এভাবে ধসে পড়ার কোনো কারণ ছিল না। যে পরিমাণ কসরত ট্যানারি শিল্পের সিন্ডিকেট চামড়ার মূল্য কমানোর সিন্ডিকেট তৈরিতে ব্যবহার করেছে, কোরবানির ঈদে এতিমের হক নষ্ট করতে বিনিয়োগ করেছে, লবণের সিন্ডিকেট এবং লবণের দাম নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে ব্যয় করেছে, তার সিকি পরিমাণ যদি কেন্দ্রীয় ইটিপি বা শোধনাগার তৈরির জন্য ব্যয় করতো, সরকারকে চাপ দিতো, নিজেরা কাজ করতো, তাহলে খাতটি টেকসই হয়ে যেত বহু আগেই!

দুই.

এ বছর সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় পশুপালনের খরচও মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। খামারিরা বলেছেন, লালন–পালনে অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে, দেশের জ্বালানি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে খামারিদের এ দাবি সঠিক।

বাংলাদেশে গেল বছর পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ। এর বিপরীতে কোরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে এ বছর কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি, কিন্তু কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকবে ২১ লাখের বেশি। টাকায় ক্রয়ক্ষমতা কমায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে এবার মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তের অনেকেই কোরবানি করতে না পারলে খামারিরা অবিক্রীত গরু-ছাগল থেকে আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

কোরবানির পশুর খামারিদের সবচেয়ে বড় ক্ষতির উৎস চাঁদাবাজি—পরিবহন চাঁদা ও পশুর হাটের চাঁদা। সংবাদমাধ্যম বলছে, একটি গাড়িকে রংপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে ১০ থেকে ১২ জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

তিন.

এ বছর গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বর্গফুটপ্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা গতবার থেকে মাত্র ৩ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশে গত এক বছরে সরকারি হিসাবে ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি হিসেবে ২০ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এক বছরে খাদ্যমূল্য ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। কাজেই মাত্র ৩ টাকা বৃদ্ধি করার মানে হচ্ছে বর্গফুটপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা করে কম দেওয়া। এতে ব্যবসায়ীরা অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি হাতিয়ে নিতে পারে। দেশে চাল-ডাল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়বে, শুধু গরিবের পণ্যের দাম, তার শ্রমের দাম বাড়বে না। চামড়ার রপ্তানিতে নানা নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধ থাকায় দেশীয় ট্যানারির মালিক এবং চামড়া সরবরাহকারীদের সিন্ডিকেটের খাতিরে অন্যায় মূল্য ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। অথচ চামড়ার দাম কত হবে, সেটা বাজারেই নির্ধারিত হওয়ার কথা।

চার.

১ হাজার টাকার চামড়া ৫০ টাকায় কিনে যদি রপ্তানি–সফল হওয়া যেত, তাহলে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের গত কয়েক বছরে এভাবে ধসে পড়ার কোনো কারণ ছিল না। যে পরিমাণ কসরত ট্যানারি শিল্পের সিন্ডিকেট চামড়ার মূল্য কমানোর সিন্ডিকেট তৈরিতে ব্যবহার করেছে, কোরবানির ঈদে এতিমের হক নষ্ট করতে বিনিয়োগ করেছে, লবণের সিন্ডিকেট এবং লবণের দাম নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে ব্যয় করেছে, তার সিকি পরিমাণ যদি কেন্দ্রীয় ইটিপি বা শোধনাগার তৈরির জন্য ব্যয় করতো, সরকারকে চাপ দিতো, নিজেরা কাজ করতো, তাহলে খাতটি টেকসই হয়ে যেত বহু আগেই!

‘দাম না ওঠানোর’ সিন্ডিকেটের কারণে দেশের বিপুল পরিমাণ চামড়া সম্পদ নষ্ট হয়ে যায় এবং গরিবের হক নষ্ট হয়। চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের এই কারসাজি মন্ত্রণালয়ে অজানা নয়। কিন্তু তারা এর বিরুদ্ধে কিছুই করে না। করলেও সেটি বরং চামড়া শিল্পের সিন্ডিকেটের পক্ষে যায় বললেও অতুক্তি হবে না।

মূলত, আন্তর্জাতিক মান, অর্থাৎ কমপ্লায়েন্সের ইস্যুটাই বাংলাদেশে চামড়াশিল্পের মূল সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। খাতটি ব্যাপকভাবে পরিবেশ–অবান্ধব বলে বিদেশি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ। ২০ বছরে কেন্দ্রীয় শোধনাগার নির্মাণে ক্রমাগত ব্যর্থতা দেখিয়েছে আমাদের সরকারগুলো, ব্যর্থতা ছিল বড় করপোরেট এবং ছোট-মাঝারি মালিক সবার। অথচ সবাইকেই কমবেশি ক্ষতিপূরণের আওতায় আনা হয়েছে। প্লটসহ অন্য সম্পদ হস্তান্তর করা হয়েছে। উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করা বর্তমান সরকার ১৪ বছরেও কাজটা করতে পারেনি।

হয়নি উচ্চমান কেন্দ্রীয় শোধনাগার, হয়নি উচ্চমান বেসরকারি শোধনাগারও। উন্মুক্ত জলাশয় ও পরিবেশে বর্জ্য ডাম্প করে, নদীতে ফেলে, বর্জ্যকে পোলট্রি ফিডে ভরে দেওয়ার মতো প্রতারণা করে বেশি দিন যে একটা রপ্তানিমুখী শিল্প টেকানো যায় না, তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমাদের চামড়াশিল্প।

ঘনবসতির দেশে বছরব্যাপী চামড়ার সরবরাহের চেইন সচল থাকায় বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের ব্যর্থ হওয়ার আসলে কোনো বোধগম্য কারণ নেই। আমরা চাই, এমন সম্ভাবনাময় শিল্পটি ফিরে আসুক। বিশ্বব্যাপী করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় চামড়াশিল্প বিলিয়ন ডলারের আয় দেখছে, এতে কেমিক্যাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির দাম বাড়ার প্রভাব থাকলেও অর্ডার বাড়বে।

এ অবস্থায় চামড়া ও চামড়াশিল্পের আয় বাড়ানোর জন্য বর্জ্য পরিশোধন এবং সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরোতে হবে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।

    ই-মেইল: [email protected]