পবিত্র রমজান মাসে স্কুল খোলা রাখা না–রাখা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে আলোচনা-বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন্তব্যগুলোর দিকে চোখ রাখছিলাম।
বেশ দুঃখ হলো এটা দেখে যে অনেকেই স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তাঁদের একমাত্র যুক্তি, রমজানে শিশুদের স্কুলে নিতে ও আনতে শিশু এবং অভিভাবক—উভয়েরই কষ্ট। তাঁর চেয়ে বরং বাচ্চারা ঘরে আরামে থাকুক। তাঁদের আরেকটা কথা, রমজানে স্কুল খোলা থাকলে শহরে যানজট বাড়বে। স্কুল বন্ধ থাকলে রাস্তাঘাট ফুরফুরা থাকবে।
মূলত এক শ্রেণির মানুষের এমন ভাবনা নিয়ে গোড়া থেকে যদি চিন্তা করি, তবে বলতে হবে এমন ভাবনা কেবলই শহরকেন্দ্রিক। অথবা বলা যেতে পারে রাজধানীকেন্দ্রিক। কিন্তু বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থী ঢাকা শহরে বসবাস করে না।
ঢাকার বাইরেও আরেকটা বাংলাদেশ আছে। সেখানেও ভালো-মন্দ মিলিয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানেও লাখো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। সেখানকার শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা কী ভাবছেন, তাঁরা রমজানে স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে কি না, সেটা স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষাবলম্বনকারীরা কমই বিবেচনায় নিয়েছেন বলে ঠাওর হয়।
আমাদের বাংলাদেশটা ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা রয়েছেন। আমরা সব মানুষের ধর্মীয় আচার পালনের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করি। সবার অধিকারকে সম্মান করি। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার কথাই ভাবতে হয়।
শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগকে বড় আকারে ধন্যবাদ জানাই, এমন একটা সিদ্ধান্তের জন্য। রমজানে স্কুল খোলা থাকছে। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, কত দিন স্কুল খোলা থাকবে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলো খোলা থাকবে। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো রমজানের প্রথম ১০ দিন, অর্থাৎ ২১ মার্চ পর্যন্ত খোলা থাকবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রমজান এলেই স্কুল খোলা থাকবে কি না, এমন একটা আলোচনার সূত্রপাত হয়। একজন সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, এটা একেবারেই অহেতুক আলোচনা। রমজানের শুরু থেকেই স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার কোনো যুক্তি হতে পারে না। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করছি।
এ পর্যায়ে একটু শৈশব-কৈশোর জীবনে ফিরে যাওয়া যাক। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে আমরা সরকারি স্কুলে পড়েছি। স্মৃতি যদি প্রতারণা করে না থাকে, তাহলে স্পষ্ট বলতে পারি, তখন রমজান এলেই স্কুল বন্ধ হয়ে যেত না। অন্তত ২০ থেকে ২২ রমজান পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা চলত। আর তখন এটা কোনো তর্ক-বিতর্কের বিষয়ই ছিল না। আমরা অপেক্ষা করতাম কবে ঈদের ছুটি শুরু হবে। ছুটি হতেই ঈদের একটা আমেজ চলে আসত। অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করত আমাদের মনে।
দুনিয়ার কোথাও রমজান এলেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায় না। মঙ্গলবার আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানির সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সেই যুক্তিই তুলে ধরেছেন। রমজানের মধ্যে সৌদি আরবে ২৮ মার্চের আগ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। একইভাবে ইরান, তুরস্ক, মিশর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রেরও উদাহরণ টানেন তিনি।
রোজা রেখে শহরকেন্দ্রিক অভিভাবকদের বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করতে একটু কষ্ট হবে, শহরে যানজটও হয়তো কিঞ্চিৎ বাড়বে, কিন্তু সন্তানদের স্বার্থে এইটুকু কষ্ট স্বীকার অভিভাবকেরা করতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। তবে স্কুলে পাঠদানের সময়সীমা যদি একটু কমিয়ে আনা যায়, সেটা মোটের ওপর দোষের নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মুসলিমপ্রধান কোনো দেশেই, কোথাও রমজানে স্কুল বন্ধ থাকে না। কোথাও ১০ দিন ছুটি নাই...কাজেই এটি কোনোভাবেই আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।’ (বিবিসি বাংলা)। এই যুক্তির বিপক্ষে রিট আবেদনকারী পক্ষ কোনো শক্ত পাল্টা যুক্তি দিতে পারেননি।
একটি খবরে পড়ছিলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতে জুমার দিন শুক্রবারেও স্কুল খোলা থাকে। এবং রমজানেও তা–ই বহাল থাকবে। তবে স্কুলে অধ্যয়নের সময়সীমা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। বেশির ভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, দুপুর ১২টার মধ্যে ক্লাস শেষ করতে।
কিন্তু আমাদের অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি ক্লাস নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং আমরা সেটাই করছি। কারণ, অনলাইনের চেয়ে সরাসরি ক্লাস শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি কার্যকর।’
দুবাইয়ের নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রাইটন কলেজের প্রধান শিক্ষক সাইমন ক্রেইন বলছিলেন, ‘শুক্রবার যেহেতু ফ্যামিলি ডে আর রমজানে আলাদা ব্যস্ততা থাকে, তাই আমরা এই দিনটিতে অনলাইনে ক্লাস নেব কি না, এমন আলোচনা হয়েছিল।
অনেকেই হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ দুবাই নয়, মালয়েশিয়াও নয়। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা খাটে না। সেটা হয়তো ঠিক। তবে এ ক্ষেত্রে খাটে। দুবাই, তেহরানের মতো শহরেও ট্রাফিক কম নয়। তারা স্কুল খোলা রাখতে পারলে আমরা কেন নয়?
আবার এমন আলাপ শুনেছি, এই কয়টা দিন স্কুল খোলা রাখলে আমাদের ছেলেমেয়েরা একেকজন বিদ্যাসাগর হয়ে যাবে কি না। অনেক ‘শিক্ষিত’ অভিভাবকও এমন পোস্ট দিয়েছেন।
কিন্তু এটা তাঁরা ভুলে গেছেন করোনার তিন বছর (২০২০-২০২২) আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। করোনায় সবচেয়ে বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল অন্যতম।
ওই সময়ে কিশোর-কিশোরীদের বড় একটি অংশ অনলাইনে নামেমাত্র ক্লাস করেছে। কিন্তু অনেক মা–বাবাই কিশোর ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু ছেলেমেয়েদের বড় অংশটি পরে সময়ে আর স্মার্টফোনের নেশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনলাইন গেম, ভিডিওসহ নানা কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এই ব্যাপারগুলো ছেলেমেয়েদের মনোজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, যা তাঁদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনের জন্য মোটেই ভালো কিছু নয়।
এখন যদি রমজানের শুরুতে স্কুল বন্ধ দেওয়া হতো, তবে আবারও মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগ পেয়ে যেত এই শিশু-কিশোরেরা। সেই দিক থেকে স্কুল চালু রাখার সিদ্ধান্ত খুবই প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক।
রোজা রেখে শহরকেন্দ্রিক অভিভাবকদের বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করতে একটু কষ্ট হবে, শহরে যানজটও হয়তো কিঞ্চিৎ বাড়বে, কিন্তু সন্তানদের স্বার্থে এইটুকু কষ্ট স্বীকার অভিভাবকেরা করতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। তবে স্কুলে পাঠদানের সময়সীমা যদি একটু কমিয়ে আনা যায়, সেটা মোটের ওপর দোষের নয়।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]