বাংলাদেশের একটি বড় সুবিধা এই যে অধিকাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা। তাই বাংলাদেশকে কোনো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা (Lingua Franca) খুঁজতে হয় না। কিন্তু বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের মূলে হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাকে উপযুক্ত স্থান দেওয়া এবং সঠিকভাবে বাংলা শেখার বিষয়টিকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে আসছি।
স্বাধীনতার পর দেশে শিক্ষার মানের দ্রুত পতনের ফলে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা একটি পৃথক ধারার দিকে অগ্রসর হয়। পরে এমনকি সরকারও ইংরেজির ব্যান্ডওয়াগনের সঙ্গে যোগ দেয়। গবেষণায় প্রচুর উদাহরণ রয়েছে যে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা থেকে ভিন্ন একটি ভাষার ব্যবহার জ্ঞান বিকাশ এবং শেখা উপভোগ করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড বাধা সৃষ্টি করে। ইউনেসকো জ্ঞানের ঘাটতি এড়াতে এবং শেখার ও বোঝার গতি বাড়াতে মাতৃভাষার ব্যবহারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
প্রাথমিক বছরগুলোতে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে যে শিক্ষা, তা শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। সার্বিকভাবে অকার্যকর হয় এবং শিশুদের শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যমের বিষয়ে দেশের যে জরুরি প্রয়োজন রয়েছে, তা হলো মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা। শিক্ষা সংস্কারে সরকারের নতুন উদ্যোগ এ বিষয়টির প্রতি পূর্ণ লক্ষ রাখছে না। প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক শিক্ষা সংস্কার প্রাথমিক স্তরে শিশুদের জন্য ইংরেজির দক্ষতার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে, তাতে সমস্যাটি আরও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের সময় প্রাথমিকভাবে বাংলা এবং পাটিগণিতের ওপর ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত এই নতুন পদক্ষেপ। এবং এটি সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিকাশের ব্যাপারে ক্ষতিকারক হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে এটাও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে একটি শিশু একটি নতুন ভাষা বেশ ভালোভাবেই শিখতে পারে, যদি তা পঞ্চম শ্রেণিতে চালু করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মাতৃভাষায় দক্ষতা একটি নতুন ভাষা আরও দ্রুত এবং কার্যকরভাবে শেখার জন্য ইতিবাচক কাজ করে।
বাংলাদেশের স্কুলব্যবস্থায় সাধারণত বাংলা শিক্ষার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয় না এবং ফলে, বাংলায় কিছু প্রকাশ করা ও লেখার ক্ষমতার বিশেষ অভাব রয়েছে শিক্ষার্থীদের। ষষ্ঠ শ্রেণিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশকারী শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বাংলা জ্ঞান নেই। তাদের বাংলায় ফোনেটিক শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতা নেই এবং তাদের বাংলা পড়ার দক্ষতার অভাব রয়েছে। বাংলা পড়ার দক্ষতার দুর্বলতার কারণে তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে বিভিন্ন বিষয়ের বিষয়বস্তু পাঠোদ্ধার করতেও অক্ষম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তুলনামূলকভাবে বাংলায় দুর্বল দক্ষতা এবং বাংলা শিক্ষায় ঘাটতি উচ্চ শ্রেণিতে সঞ্চারিত হয়। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের বাইরে বই পড়ার সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত—এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া অনেক সুবিধাবঞ্চিত বিদ্যালয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, গ্রন্থাগার নেই বললেই চলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেহাল বাংলা ভাষা থেকে পুরো সমস্যাটির বিশালতার কিছু ইঙ্গিত মেলে।
বাংলা পাঠ্যক্রমে উচ্চমানের সাহিত্যের কমতি হচ্ছে ক্রমশ। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলায় নতুন পাঠ্যক্রম একটি ব্যবহারিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশংসনীয়ভাবে বাংলা শেখার ওপর জোর দেয়। কিন্তু সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে দুর্বলতা থেকে গেছে। সাহিত্য চিন্তনশক্তি বাড়ানোর আমন্ত্রণ জানায় এবং সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটায়। সাহিত্য প্রায়ই যত্নসহকারে পড়ার প্রয়োজন হয়, যাতে লেখক বা কবি কী বলতে চান, তা সম্যকভাবে বোঝা যায়। সাহিত্য পড়া মস্তিষ্কের জন্য একটি ব্যায়াম, মস্তিষ্ককে সক্রিয় এবং সতেজ রাখার জন্য। সাহিত্য পড়া শব্দভান্ডার, উচ্চারণ এবং যোগাযোগ ও উপস্থাপনা দক্ষতা উন্নত করে। সাহিত্যের এসব সুবিধা পাঠ্যক্রমজুড়ে থাকলে মানসিক বিকাশে এবং জীবনেও সহায়ক হয়।
ভাষা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল ও উন্নয়নমূলক ভূমিকার পাশাপাশি, প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির ভাষায় পারদর্শী হওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা এখন সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যম, যদিও বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত ডিগ্রির জন্য ইংরেজি খুব বেশি প্রয়োজন। দেশের অভ্যন্তরে সর্বস্তরে এবং সব সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার করা হয়।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাবলিক শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার ঘাটতিগুলো দূর করার জন্য আমরা নিচের প্রস্তাবগুলো পেশ করছি:
১. প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা শেখানো উচিত ভাষার সব দিকের—শব্দভান্ডার, উচ্চারণ এবং বানান, কথা বলা, শোনা, পড়া এবং লেখার—ওপর জোর দিয়ে। পাঠ্যপুস্তকগুলোয় এমন উপকরণ ব্যবহার করে ডিজাইন করা উচিত, যাতে তরুণ শিক্ষার্থীরা আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে শিখতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষাকালেই শিশুদের বইপ্রেমী এবং সব বয়সে বই পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
২. ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে বাংলা সাহিত্য থেকে ক্রমবর্ধমান কঠিন ধরনের প্রবন্ধ এবং কবিতা রাখা উচিত বাংলায়। পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুতে অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের কিছু কিছু অংশের বাংলা অনুবাদও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি শিক্ষার্থীদের বাইরের বিশ্বের একটি আভাস দেবে এবং জগৎ সম্পর্কে কল্পনাকে উন্মুক্ত করবে।
পাঠ্যক্রমের নতুন পরিবর্তনগুলো বাংলায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাংলার প্রধান ভূমিকাও যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি।
৩. বাংলা শেখানোর জন্য শিক্ষকদের ভাষা শিক্ষার একটি ভালো ভিত্তি থাকা উচিত। নতুন পাঠ্যক্রমের জন্য সঠিক শিক্ষাবিদ্যার ওপর অবিলম্বে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পাঠ্যক্রমের সাফল্যের উদ্দেশ্যে। অল্প সময়ে প্রশিক্ষণের সুফল অর্জন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। প্রশিক্ষণের একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রয়োজন হতে পারে, যা শিক্ষকদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে কার্যকর পদ্ধতিতে ক্লাস পরিচালনা করার ক্ষমতা দেবে।
৪. দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা শিক্ষা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সরকারের উচিত একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা। এতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করবে অন্যান্য ভাষায় (বিশেষ করে, ইংরেজি) সাহিত্যের ও বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষার উপযোগী বইয়ের বাংলা সংস্করণ তৈরি করতে। অথবা সরকার লেখকদের আমন্ত্রণ জানাতে পারে তাদের নিজস্ব বই বাংলায় লেখার জন্য।
পাঠ্যক্রমের নতুন পরিবর্তনগুলো বাংলায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাংলার প্রধান ভূমিকাও যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি।
জসিমউজ জামান ও মতিলাল পাল দুজনই ‘শিক্ষার সামাজিক দায়িত্ব’ (এসএসডি) পদ্ধতি ব্যবহার করে মানসম্মত শিক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন এবং গ্রামীণ বাংলাদেশে মানসম্মত শিক্ষা বইটির সহ-লেখক।