সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে বলা যায়। ‘অনলাইন’ ও ‘অফলাইন’ জীবন বলেও কিছু টার্ম এখন চর্চিত বিষয়। অর্থাৎ একটা মানুষের যেমন অনলাইনে এক রকম জীবন কিংবা জীবনদর্শন থাকতে পারে; ঠিক তেমনি অফলাইন কিংবা বাস্তবেও অন্য আরেকটা জীবন আছে। সমস্যাটা তৈরি হয়, যখন বাস্তবের সঙ্গে অনলাইন জীবন কিংবা জীবনদর্শনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
ধরুন অনলাইন, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে আপনি একজন মানুষকে যেভাবে দেখছেন। সেই মানুষই হয়তো বাস্তব জীবনে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্ন হওয়াটাও দোষের কিছু নয়।
একজন মানুষের বিভিন্ন পরিচয় যেমন থাকতে পারে, তেমনি একজন মানুষ এক জীবনে নান রকম কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যাটা বাধে তখনই, যখন আপনি অনলাইনকে ব্যবহার করে মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে নিজের ফায়দা হাসিল করছেন।
ইদানীং ফেসবুক কিংবা ইউটিউব খুললেই দেখা যায়, অনেকেই সমাজের জন্য অনেক কিছু করে বেড়াচ্ছে। কেউ গরিবদের নানাভাবে সাহায্য করছে। কেউ অসহায় মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কেউ আবার বিনা মূল্যে বিভিন্ন জিনিস বিলিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব তারা ভিডিও করে অনলাইনে ছাড়ছে। এরপর মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে কেউ দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলেছে। কেউ মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পেয়ে কোটি টাকা দামের গাড়ি-বাড়ি করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি সবাই বাস্তব জীবনে সত্যি সত্যি এমন দানবীর কিংবা সমাজসেবক?
আজকাল প্রায়ই পত্রপত্রিকায় কিছু ঘটনা সামনে চলে আসছে। অনলাইনের এমন কিছু সেলিব্রিটিকে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ নীতিনৈতিকতা–বিবর্জিত কাজ করে বেড়াতে। কেউ অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে উল্টো তাদের ওপর অত্যাচার করছে। কেউ মানুষকে ফ্রি জিনিসপত্র বিলিয়ে বেড়ানোর ভিডিও বানিয়ে নিজেই কিংবা নিজের পরিবারের ঋণখেলাপির পক্ষে সাফাই গাইছে। অর্থাৎ অনলাইনের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই! কিন্তু মানুষের আবেগ তারা ঠিকই কাজে লাগাতে পারছে।
কই, বছর কয়েক আগেও তো এত সমাজসেবককে অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন এত এত পাওয়া যায় কেন? উত্তরটা খুব সহজ—ভিডিও বানিয়ে অর্থ উপার্জন করা যায়। এতেও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা হয় যখন মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে তারা অনৈতিক কাজ করে বেড়ায়। এখন এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
এরপর তাদের পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আবার অনলাইনে নানা বিতর্ক চলছে। অর্থাৎ একজন অসৎ, অন্যায়কারীর পক্ষেও এ দেশে মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এটা হচ্ছে? কেন একজন অন্যায়কারীর পক্ষেও মানুষ পাওয়া যাচ্ছে?
কারণ, অনলাইনের এই ‘সমাজসেবকেরা’ এর মধ্যেই অনেক মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। সেই আবেগ থেকে সাধারণ ফ্যান-অনুসারীরা আর বের হতে পারছে না। এমন অনলাইন সেলিব্রিটির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় তো এমন দেখা যায় না খুব একটা। সেখানে তো শত শত সমাজসেবককে অনলাইনে পাওয়া যায় না। শত শত ভালো মানুষকে অনলাইনে দেখা যায় না। তাহলে বাংলাদেশে কেন তাদের সংখ্যা এত বাড়ছে?
অনলাইনের এই ভালো মানুষগুলো কি আদৌ ভিডিও বানাবে, যদি ভিডিও দেখিয়ে টাকা রোজগার করা না যায়?
কই, বছর কয়েক আগেও তো এত সমাজসেবককে অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন এত এত পাওয়া যায় কেন? উত্তরটা খুব সহজ—ভিডিও বানিয়ে অর্থ উপার্জন করা যায়। এতেও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা হয় যখন মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে তারা অনৈতিক কাজ করে বেড়ায়। এখন এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
উত্তরটা খুব সহজ। উন্নত দেশগুলোয় তো এত সমাজসেবক দেখা যায় না। এর কারণ, রাষ্ট্রই মানুষ ও সমাজের সেবা করে। আপনি অসুস্থ হলে রাষ্ট্র আপনার দেখভাল করবে। আপনি অসহায় হলে রাষ্ট্র আপনাকে আশ্রয় দেবে। আপনার যদি খাদ্য কিংবা বস্ত্রের অভাব থাকে, রাষ্ট্রই এর ব্যবস্থা করবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা রাষ্ট্র এসব কাজে ব্যয় করে। আর আমাদের দেশে কী হয়?
দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ এসব সেবা থেকে বঞ্চিত। আর সেই সুযোগে কিছু মানুষ সমাজসেবক বনে যায় মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে। তখন সাধারণ মানুষ তাদের সাধু ভাবতে শুরু করে। এরপর খুব সহজেই এসব মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে অনৈতিক কাজ করে বেড়ানোও যায়।
একটা দেশের মানুষ যদি তাদের সাধারণ মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকভাবে পায়, তাহলে আনাচকানাচে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে এরকম ‘মুখোশধারী’ সমাজসেবক গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। তাই রাষ্ট্রকে মানুষের দায়িত্ব নিতে হবে। একটা রাষ্ট্র যখন তার দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালন করবে, তখন সে রাষ্ট্রই সমাজসেবকে পরিণত হয়।
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি ই-মেইল: [email protected]