প্রশ্ন উঠেছে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর কি খুন হয়েছেন না আত্মহত্যা করেছেন? গত ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হন তিনি। ৬ নভেম্বর শীতলক্ষ্যা নদীতে ফারদিনের লাশ পাওয়ার পর তদন্ত শুরু করে ডিবি। ছায়া তদন্তে নামে র্যাব। তবে শুরু থেকে দুই সংস্থা দুই ধরনের তথ্য দিতে থাকে। র্যাব কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হান গ্যাং ফারদিন হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ডিবির বক্তব্য ছিল, র্যাবের দাবি ঠিক নয়।
ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর প্রথম আলোয় লিখেছিলাম: ‘ফারদিনকে কারা খুন করল কেন খুন করল’। সেই প্রশ্নের জবাব কি আদৌ পাওয়া গেল? ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন মামলা করেছিলেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ‘৪ নভেম্বর বেলা তিনটার দিকে ফারদিন নূর ডেমরার কোনাপাড়া এলাকার বাসা থেকে বুয়েটের উদ্দেশে বের হন। পরদিন ৫ নভেম্বর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাসায় ফিরে মায়ের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ছিল তাঁর। পরবর্তী সময় তাঁরা (মা-বাবা) জানতে পারেন, ফারদিন নূর পরীক্ষায় অংশ নেননি এবং তাঁকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুয়েটের শিক্ষক ও ফারদিনের সহপাঠীরা তাঁর মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তাঁকে পাচ্ছেন না, তা বন্ধ পাওয়া যায়। বিষয়টি জানতে পেরে ৫ নভেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরাও (মা-বাবা) মুঠোফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ছেলের সন্ধান পাননি তাঁরা। এই মামলার ফারদিনের বান্ধবী আয়াতুল্লাহ বুশরাসহ কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। হত্যা মামলা করেছিলেন। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব তদন্তে নেমে একেক কথা বলতে থাকে।’
তদন্ত সংস্থা ডিবির তদন্ত ভুল না সঠিক সেই সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তদন্তের এই ফলাফল আমাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি, আমাদের সংশয় কাটেনি। ফারদিনের সহপাঠীরা যেসব প্রশ্ন করেছেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হওয়া জরুরি। আমাদের তদন্ত সংস্থা অনেক ঘটনার রহস্য তারা উদ্ঘাটন করেছে, আবার অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। কিছু ঘটনা রহস্য ভেদ করতে না পারার বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে রহস্যময়।
ফারদিন নূর ছিলেন বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন। বিতার্কিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাঁর স্পেন যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে তাঁকে।
ঘটনায় প্রায় এক মাস দশ দিন পর বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর হত্যা মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হলেও এখন তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাবি করেছে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। এক মাসের বেশি সময়েও ফারদিন হত্যা মামলা তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় তাঁর পরিবার ও সহপাঠীদের মধ্যে হতাশা ছিল। যদিও প্রথম দিকে ফারদিনের বাবা বলেছিলেন, তিনি তদন্ত সংস্থার প্রতি আস্থা হারাতে চান না। ফারদিনের লাশ পাওয়ার পর ময়নাতদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফারদিনের পুরো মাথার বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। বুকের ভেতরে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড।
ডিবি এখন বলছে, তারা ফারদিনের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গেও একাধিকবার কথা বলেছে। ভিসেরা প্রতিবেদন পেলে চিকিৎসকেরা পূর্ণাঙ্গ মতামত দেবেন। সংস্থাটির দাবি, ফারদিনের মাথায় খুব সামান্য আঘাত ছিল, এ আঘাতের কারণে অজ্ঞান হতে পারেন। কিন্তু মৃত্যু হবে না বলে মৌখিকভাবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। গণমাধ্যমের সামনে চিকিৎসক মাথায় কয়েকটা আঘাতের চিহ্নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পারিবারিক চাপ, দুই ভাইয়ের পড়াশোনার টাকা জোগানো, ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে স্পেনে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে না পারাকে ‘আত্মহত্যার’ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে ডিবি। ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারদিন আত্মহত্যা করতে পারে বলে আমরা তাঁর মাকে অবহিত করেছিলাম। আমরা ঘটনার পর বুয়েটের শিক্ষক, সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ফারদিনের পড়াশোনা, পরীক্ষার ফল সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি।’
ফারদিন নূর পরশের বাবা কাজী নূরউদ্দিন ডিবির তথ্য মানতে পারেননি। তিনি মিন্টো রোড ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি নারাজি দেব, ১০০ বার নারাজি দেব। আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না।’ রামপুরা থেকে ফারদিনের যাত্রাবাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ পোষণ করে তিনি বলেছিলেন, 'ফারদিনকে হয়তো এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে বন্দুকের মুখে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছে। তাকে অপরাধীদের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য করা হতে পারে...। তদন্তকারীদের উচিত আমাদের সব জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ দেখানো...। যে ছেলে রাত ১১টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসত, সে কেন এসব সন্দেহজনক স্থানে এভাবে ঘুরবে?’
ফারদিন নূর আত্মহত্যা করেছেন বলে ডিবি যে বক্তব্য দিয়েছে, তার ‘প্রমাণ’ দেখতে বুয়েটের একদল শিক্ষার্থী মিন্টো রোডে সংস্থাটির কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা ডিবির শীর্ষ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে বুয়েট ছাত্র তাহমিদ হোসেন বলেন, ‘ব্রিজের যে পারে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে যে মাঝখানে ব্যাক করেছে, ওই জায়গায় তার সঙ্গে কে ছিল বা সে একদম একা ছিল কি না-এ বিষয় পরিষ্কার নয়। লেগুনাচালক নাকি বলেছেন, দুজনকে নামানো হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আরেকজন নেমেছিলেন। কে নেমেছিলেন, সেটা পরিষ্কার নয়। এর বাইরে অন্য জিনিসগুলোর কংক্রিট অ্যাভিডেন্স তাঁরা টু অ্যান এক্সটেন্ট দেখিয়েছেন। তাঁরা আমাদের কিছু সারকামস্ট্যানশিয়াল অ্যাভিডেন্স দেখিয়েছেন, যা দেখে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ওই রকম কংক্রিট, সলিড কোনো তথ্য, অতটা তাঁরা দেখাননি। আত্মহত্যার মোটিভটা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় কি না, এ জায়গায় ভবিষ্যতে কাজ করা যেতে পারে। ডিবি বলেছে, তারা এটি নিয়ে কাজ করবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বুধবার বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মতামত নিয়ে এবং ডিবির তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা মনে করছেন ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। বুয়েট শিক্ষার্থীদের কথা অনুযায়ী আরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তার আগে বলা যাবে না ফারদিনকে কেউ খুন করেছেন, না তিনি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।
প্রশ্ন হলো তদন্ত পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই একেক সংস্থা একেক তথ্য হাজির করল কীভাবে? কীভাবে তারা জানিয়ে দিলেন, অমুক স্থানে অমুকের হাতে ফারদিন খুন হয়েছেন। এমনকি তদন্ত সংস্থার বরাত দিয়ে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ফারদিনকে মাদকসেবী হিসাবে প্রমাণের চেষ্টাও করেছিল। অতীতেও দেখা গেছে, কোনো সহিংসতা বা অঘটন ঘটলে একাধিক সংস্থা তদন্ত শুরু করে। তদন্ত নিয়ে তদন্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা রেষারেষির দৃষ্টান্ত অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়ে সে রকম কিছু হয়েছে কিনা সেটাও তদন্ত করা দরকার।
ডিবির তথ্যানুযায়ী, ফারদিন চার জায়গায় ছাত্র পড়াতেন। সেই টাকা দিয়ে নিজের ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। এটা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার একটা দিক। ফারদিনের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করলেও রাষ্ট্র বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পান না। বিদেশে শিক্ষা ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের এখানেও চালু করা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই কর্মসূচি সফল হয়নি। ডিবির ভাষ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারলে সে হয়তো মানসিকভাবে এতটা ভেঙে পড়ত না। ডিবির ভাষ্য মতে যদি সত্যিই এই টাকা ফারদিনের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে তবে এটা বলতে হয় যে এ রকম মেধাবী তরুণের জীবন মাঝপথে মর্মান্তিকভাবে থেমে যাওয়ার দায় রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
তদন্ত সংস্থা ডিবির তদন্ত ভুল না সঠিক সেই সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তদন্তের এই ফলাফল আমাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি, আমাদের সংশয় কাটেনি। ফারদিনের সহপাঠীরা যেসব প্রশ্ন করেছেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হওয়া জরুরি। আমাদের তদন্ত সংস্থা অনেক ঘটনার রহস্য তারা উদ্ঘাটন করেছে, আবার অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। কিছু ঘটনা রহস্য ভেদ করতে না পারার বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে রহস্যময়।
সাংবাদিক সাগর রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা আদালত থেকে ৯০ বার সময় নিয়েছেন। এই সময় চাওয়ার সময়েরও একটা সীমারেখা থাকা উচিত।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি