প্রগতিশীল আর রক্ষণশীলের ফারাক কোথায়?

হল্লা চলছে। পক্ষে-বিপক্ষে ছুটছে কথার তুবড়ি। আদর্শকে বইমেলায় স্টল দেওয়া হয়নি। কাজটা ঠিক হয়েছে; ঠিক হয়নি। ফারাজকে ‘নায়ক’ বানানো হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক হয়েছে; ঠিক হয়নি। ঠিক-বেঠিকের বাইরেও এক দিগন্তের সন্ধান করেছিলেন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। মিলনের আকুতি প্রকাশে তিনি কবিতায় বলেছিলেন, ‘তোমার সাথে মিলব আবার ঠিক-বেঠিকের বাইরে।’

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো, রাজনীতি নিয়ে বলতে বসে সুফিদর্শন গাইছি না। রাজনীতির অন্তরে উঁকি দিয়ে দেখছি, এ দেশের রাজনীতি আজ কট্টর মিলন-বিভেদের ডাইকোটোমিতে বন্দী। ‘হয় তুমি আমার দলে, নয় তুমি আমার শত্রু’—এমনই এক আবহ বিরাজমান।

কথায় কথায় একে অন্যকে নানা ট্যাগ মেরে দিচ্ছি। যা কিছু নিজের মতের সঙ্গে মেলে না তার সবকিছুই ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার ধুন্দুমার আয়োজন দেখছি চতুর্দিকে। এ আয়োজন কট্টর ও উদার তথা রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল দুই শিবিরেই দেদার চলছে। আয়োজনের বহর দেখে মনে হয়, ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’।

বই লেখার অপরাধে এক শিবির কতল করার জন্য ছুরি শাণ দেয়। আরেক শিবির জবান বন্ধ করার নিমিত্তে শাণ দেয় জিহ্বা ও আইন। উভয় শিবিরেই দেখি, নিয়ন্ত্রণবাদী মন অবিরত বাজায় যুদ্ধের দামামা। অথচ আমাদেরই কিনা শেখানো হয়েছে আপ্তবাক্য, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন দেব।’

হায়! কী দেখার কথা, কী দেখছি! অন্যের মতপ্রকাশের পক্ষে জীবন দেওয়ার বদলে বিপরীত মতধারীর জান ও জবান কেড়ে নেওয়ার জন্য খড়্গ, কৃপাণ, তরবারি ও আইন হাতে আমরা বেদম ছুটছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিচ্ছেন। কেননা তিনি মনে করছেন, তার দেখনভঙ্গিটাই সেরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পার্কে প্রেম করতে যাওয়া কপোত-কপোতীদের কখনো আটক করছেন ইউএনও কখনো বা ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রেম করতে গিয়ে পরস্পরের গা ঘেঁষে বসা বা হাতে হাত ধরা বা কাঁধে মাথা রাখার নাম দেওয়া হয় ‘প্রকাশ্য দিবালোকে অসামাজিক কার্যক্রম’। তারপর আটক প্রেমিক-প্রেমিকাদের অভিভাবক এসে মুচলেকা দিলে মুক্তি। যে সরকারি কর্তারা এমন কাণ্ড করছেন, তাঁরাও মনে করছেন তাঁদের দেখার ভঙ্গিটাই বিশুদ্ধ। 

চিন্তার সুপ্রিমেসি। অর্থাৎ নিজের মতাদর্শ বা চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা। হিটলারের শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা যে অর্থে খারাপ, যে অর্থে হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব বর্জনীয় সেই একই কারণেই আপনার চিন্তার শ্রেষ্ঠত্বও দূষণীয় ও বর্জনীয়। সিনেমার চরিত্রায়ণে পুলিশকে ‘হেয়’ করা হয়েছে, এমন অভিযোগে চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর ২০২০-এর বিবিসি বাংলার খবরে বলছে, ‘পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে এবং পর্নোগ্রাফি আইনে মামলায় চলচ্চিত্রটির পরিচালক অনন্য মামুন এবং অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেপ্তারের পর আজ কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’

কী ছিল তাদের অপরাধ? বিবিসি জানাচ্ছে, ‘নবাব এলএলবি’ নামের চলচ্চিত্রে ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের একটি দৃশ্যে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা হয়, যা পর্নোগ্রাফি আইনে অপরাধ বলে তারা মনে করেন।’ লক্ষ করুন, ‘অশ্লীল ভাষা ব্যবহার’। এই একই অভিযোগ ‘সুশীল’ অনেক নেটিজেনকে করতে দেখেছি হাওয়া সিনেমায় ব্যবহৃত ভাষার বিরুদ্ধেও। শ্লীল আর অশ্লীলের সীমানাটাও রুমিবর্ণিত ‘ঠিক-বেঠিকের’ মতো। ইংরেজি ছয় আর নয় যেমন। ছয় যিনি দেখছেন তিনিও সত্য এবং নয় যিনি দেখছেন, তিনিও সত্য। মানে দুজনই সত্য, দুজনই ভুল। অর্থাৎ সমাজে ঠিক-বেঠিকের বাইরেও এক বাস্তবতা আছে।

বই লেখার অপরাধে কারও কল্লা ফেলে দেওয়া, নিউজ করার ‘অপরাধে’ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে কারও বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট লাগিয়ে দেওয়া, পুলিশের চরিত্রকে ‘হেয়’ করার অপরাধে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা, একই রং-এর বিভিন্ন শেডমাত্র। মানে কাজের প্রকাশের ডিগ্রিতে তারতম্য থাকলেও তারা সবাই নিয়ন্ত্রণবাদী।

সিনেমার ভাষায় এই বাস্তবতাকে বলে ‘রশোমন ইফেক্ট’। আকিরা কুরোসাওয়ার যুগান্তকারী চলচ্চিত্র রশোমন। সত্যের কোনো ‘একম’ এবং ‘অদ্বিতীয়ম’ রূপ যে নেই সেই সত্যই হাজির করে রশোমন। ফ্যাক্ট এক থাকলেও ব্যাখ্যা বা বয়ান বা ন্যারেটিভ ভিন্ন হতে পারে। এই ভিন্ন দেখাটাকেই বলে পার্সপেক্টিভ। সমাজ কোনো রেজিমেন্ট নয় যে, এখানে ঝাঁকের কইয়ের মতো সবাই এক ক্ষুরে মাথা কামাবেন।

এই সমাজ যতখানি আমাদের তথাকথিত ‘সুশীল’ নাগরিকদের ততখানিই হিরো আলম বা টিকটকার অপু ভাইয়ের। কিন্তু ‘হিরো আলমের মতন’ ব্যক্তির রবীন্দ্রসংগীত গাইবার অধিকার আছে কি না, নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন কি না সেই প্রশ্ন আমাদের মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যমই তোলা হচ্ছে।  ‘অশিক্ষিত, গরিব’ হয়েও পশ্চিমা শিল্পীদের অনুকরণে চুল কেটে, পোশাক পরিধান করে ‘বড়লোকি চালে’ চলা টিকটকার অপু ভাইকেও যা নয় তাই বলে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে।

মেনে নিলাম, আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু হিরো আলমের গান গাইবার অধিকার, টিকটক করার অধিকার পর্যন্ত হরণ করার জন্য সুশীলদের যখন গলা উঁচু করতে দেখেছি, সেখানে কট্টরের আর উদারের ভাষায় কোনো ফারাক পাওয়া যায়নি। একই নিয়ন্ত্রণবাদী মানসিকতা থেকেই কয়েক বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল সিনেমা শনিবার বিকেল। অবশেষে, বরফ গলল। শনিবার বিকেল-এর মুক্তি মিলল চিন্তাকে বন্দী রাখার জেলখানা থেকে।

আরও পড়ুন

বই লেখার অপরাধে কারও কল্লা ফেলে দেওয়া, নিউজ করার ‘অপরাধে’ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে কারও বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট লাগিয়ে দেওয়া, পুলিশের চরিত্রকে ‘হেয়’ করার অপরাধে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা, একই রং-এর বিভিন্ন শেডমাত্র। মানে কাজের প্রকাশের ডিগ্রিতে তারতম্য থাকলেও তারা সবাই নিয়ন্ত্রণবাদী। কট্টর হোক আর উদার হোক নিজের মতের বাইরে গেলেই কেউ আইন আর কেউ চাপাতি নিয়ে দৌড়ে আসে। এই ভেবেই কি কবি লিখেছিলেন, ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা’?

কয়েক বছর আগে মুক্তি পেয়েছিল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র ডুব। সিনেমাটি নিয়ে তখন ভীষণ সমালোচনা চলছিল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এই সিনেমা বানানো হয়েছে বলে দাবি করে কেউ কেউ বাস্তব চরিত্রকে কতটা বাস্তবভাবে দেখানো হয়েছে সেই প্রশ্ন ও বিতর্ক তুলেছেন। কিন্তু আমার অবস্থান ছিল এর বিপরীত।

ডুব দেখে আমার ভালো লাগে। সেই সময় চলতে থাকা প্রখর সমালোচনার বিপরীতে নিজের মতামত তুলে ধরে একখানি আলোচনা লিখেছিলাম। বলেছিলাম, সত্যের ছায়া থাকলেও এই সিনেমা সত্য নয়। এটি ফিকশন। মানে চলচ্চিত্র পরিচালক অন্তত এটিকে হুমায়ূনের জীবনী দাবি করেননি। কিন্তু সেই আলোচনা লেখার পর আমার তো আর ‘রক্ষে নেই’ দশা! টাকা খেয়ে সমালোচনা লিখেছি এমন কথাও লোকে যেচে পড়ে এসে শুনিয়ে গেছে। যদিও ফারুকীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয়ই নেই বা সিনেমার কলাকুশলীদের কাউকেই আমি আজও চিনি না।  

তো ফারাজ সিনেমাটি বাংলাদেশে যেন ওটিটিতে মুক্তি না পায়, সেই মর্মেও আলাপ উঠেছে। চিন্তার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান করছি। ফারাজ কোনো ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র নয়। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এটি একটি ফিকশন। হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের গণজীবনের গণস্মৃতির একটি অংশ। এ ঘটনা নিয়ে নানান কাহিনি হয়তো রচিত হবে।

এমনকি আমার সেই রাতের স্মৃতি নিয়েও একটি সিনেমা হতে পারে। সেই রাতে বিবিসি বাংলার নিউজরুমে ছিলাম আমি। ছিলেন আরও সিনিয়র কয়েকজন সহকর্মী। আমরা সবাই মিলে সকালের অধিবেশন ‘প্রভাতি’ ও ‘প্রতুষ্যা’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিউজরুমের যে আবহ ছিল, সেটি নিয়েও হতে পারে সিনেমা।

সিনেমায় কতখানি কী দেখালে ‘সীমারেখা লঙ্ঘন’ করা হয়, তা দেখার আগে বলার সুযোগ নেই। আবার হোলি আর্টিজানের এ ঘটনাটিকে প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারত কোন চোখে ব্যাখ্যা করে, সেই পার্সপেক্টিভ বা দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের জানার প্রয়োজন আছে।

এখানেই আবার রশোমন ইফেক্ট স্মর্তব্য। রশোমন আমাদের স্মরণ করায়, একই ফ্যাক্টকে ভিত্তি করে উঠে আসতে পারে ভিন্ন ভিন্ন পার্সপেক্টিভ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশিদের কাছে বিজয় দিবস। কিন্তু একই ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের কাছে ‘ফল অফ ঢাকা’ বা ‘ঢাকার পতন’। আবার এই একই ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বয়ানে অন্য ব্যাখ্যায় হাজির হয়।

আরও পড়ুন

ফলে যেকোনো অভিযোগেই ফারাজ সিনেমার মুক্তি আটকানোটা কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না। যদি এই সিনেমায় সত্যের অপলাপ থাকে, ডিসটর্শান থাকে, তাহলে সেগুলোরও আলোচনা ও সমালোচনা হাজির করতে হবে। টেক্সটের জবাব হবে টেক্সট। অর্থাৎ শিল্পের জবাব হবে শিল্প এবং মুক্তবাক। কিন্তু টুঁটি চেপে ধরা ভুল সিদ্ধান্ত। একই কথা প্রযোজ্য ‘আদর্শ’-এর ক্ষেত্রেও। যে বইটি নিয়ে অভিযোগ এনে প্রকাশনী সংস্থা আদর্শকে স্টল বঞ্চিত করা হয়েছে, সেটি অন্যায্য হয়েছে। নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করারাও যখন কট্টরের মতো নিয়ন্ত্রণবাদী আচরণ করেন, তখন প্রগতিশীল আর রক্ষণশীলের ফারাক কোথায়?

  • আফরোজা সোমা কবি, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক