এবার জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৫৭ সদস্যের একটি বৃহৎ দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। তিনি এই ভ্রমণ শুরু করেন নিউইয়র্ক থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর মূল কর্মসূচি ছিল ৪ দিন পর, অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সকাল ১০টায় একটি বক্তৃতা দেন।
তবে মাঝের ৪ দিন তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করেছেন। ওয়াকিবহাল মহলের তথ্যমতে, ভূরাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো হচ্ছে ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
সুতরাং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এসব দেশের নেতাদের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠক হয় কি না এবং তার ফলাফল কী হলো তা পর্যবেক্ষণ করা। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে আমেরিকায় অবস্থানরত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনো সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ, মোদি ২৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকা ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দিয়েছিলেন।
এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা, নাকি ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া—এ নিয়ে নানা জল্পনা–কল্পনা বিদ্যমান। তবে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা অম্লমধুর জায়গায় গেছে। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের শীতলতা ক্রমহ্রাসমান।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এক দিন পরেই, অর্থাৎ ২৪ তারিখ সকাল ১১টায় (নিউইয়র্ক সময়) ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রতিনিধি বিল ক্লিনটন ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিএনপি কার্যালয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকের পর মির্জা ফখরুলও বলেন, ‘বাংলাদেশে গত নির্বাচনের পর থেকে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। তবে হাইকমিশনারের আমাদের কার্যালয়ে আসাটা অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বরফ গলতে শুরু করেছে।’ [সোহরাব হাসানের কলাম, প্রথম আলো, ২৯/৯/২০২৪]
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তী সময়ে তাঁদের অন্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকগুলোর খবর ও ছবি ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। এই নিয়ে যতটুকু সংবাদ পৌঁছেছে এবং তা থেকে আমরা যতটুকু জেনেছি তা হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
ড. ইউনূস সরকারের প্রশংসা করে সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই সাধারণ আশ্বাসের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট, সন্ত্রাস দমন, শ্রমবিষয়ক সংকট ও পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের বিষয়েও মার্কিন সরকারের সঙ্গে ড. ইউনূসের আলোচনা হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের ইস্যুটিও আলোচিত হয়েছে। তবে সেগুলো নিয়ে খুঁটিনাটি বিবরণ এখনো প্রকাশিত হয়নি। আমরা এ–ও জানি, পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। বিশেষত, হাসিনা সরকার ইন্দো-আমেরিকান অক্ষশক্তির বদলে ভারত-চীন-রাশিয়ার প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়েছিলেন বলে কথিত আছে।
এমনকি চীনের প্রতি তার ঝোঁক বেশি—এ রকম অনেক সমালোচনা পশ্চিমা কূটনৈতিক মহল থেকে প্রায়ই করা হতো। আমরা এ-ও জানি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছিলেন, আমেরিকা তাঁকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
কাতার ও সুইজারল্যান্ড থেকে ভ্রমণ শেষে বছরখানেক আগে ২১ জুলাই ২০২৩ তারিখে গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমাদের ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটি হবে না।’
ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি অবশ্য তখন যুক্তরাষ্ট্রের বা বিশেষ কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি। যদিও কোনো এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি (?) এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে উল্লেখিত হয়েছিল। ২০২৪–এর নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা পরবর্তী সময়ে আরও অভিযোগ করেছিলেন, ২০০১ সালে বিএনপি গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন তারা সেন্ট মার্টিন বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে।
সেই সময় এই বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে বিএনপি বলেছিল, এসব কথা নিতান্তই শেখ হাসিনার ‘নির্বাচনী কৌশল’ মাত্র। পরবর্তী সময়ে ড. আলী রীয়াজ লিখিত প্রাসঙ্গিক এক কলামে লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেননি। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, তিনি সেদিকেই ইঙ্গিত করছিলেন... এ অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে এবং এর মধ্যে সেন্ট মার্টিনও রয়েছে।’
কর্তৃপক্ষের এই অস্বীকৃতি ও অন্যান্য আমেরিকান রাষ্ট্রীয় বক্তব্যের উদ্ধৃতি তুলে ধরে আলী রীয়াজ তাঁর কলামে লিখেছেন, শেখ হাসিনার ইউএসএর বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ দুরভিসন্ধিমূলকও হতে পারে। অর্থাৎ আমেরিকান হুমকির কথা বলে তা থেকে প্রতিকারের জন্য অন্য কোনো শক্তিকে ডেকে সেখানে স্থান দেওয়ার কোনো ষড়যন্ত্রও এটা হতে পারে।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক মার্কিনিদের নতুন উদীয়মান বন্ধুত্ব ও পুরোনো শত্রুতার (১৯৭১-৭৫ কালপর্ব দ্রঃ) একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তাই ভবিষ্যতে আমাদের এই ‘নতুন উদীয়মান বন্ধুত্ব’ আমাদের কোন দিকে নিয়ে যায়—এ ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদবিরোধী সব শক্তিকে সতর্ক থাকতে হবে।
এ কথা ঠিক, মোদির সঙ্গে বাইডেনের মতো কোনো উষ্ণ ঘনিষ্ঠ বৈঠক এবার ড. ইউনূসের হয়নি। অনেকে এটিকে ভারতের সঙ্গে ‘শীতল’ সম্পর্কের ইঙ্গিত বলছেন। বিশেষ করে এই সরকারের ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাটিও বিশেষভাবে অনেকের চোখে পড়েছে। কিন্তু দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবার এই নিষেধাজ্ঞা পুনরায় প্রত্যাহার করায় বোঝা যায়, এই শীতলতাও হয়তো স্থায়ী কোনো ব্যাপার নয়।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিএনপি কার্যালয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকের পর মির্জা ফখরুলও বলেন, ‘বাংলাদেশে গত নির্বাচনের পর থেকে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। তবে হাইকমিশনারের আমাদের কার্যালয়ে আসাটা অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বরফ গলতে শুরু করেছে।’ [সোহরাব হাসানের কলাম, প্রথম আলো, ২৯/৯/২০২৪]
তবে বিএনপি–ও দলটির মূল নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যে ‘দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা’ রয়েছে, সেটার সত্যতা কতটুকু সেটাও নিশ্চয় ভারতের কাছে একটি ইস্যু হিসেবে যত দিন ঝুলে থাকবে, তত দিন সম্পর্ক কিছুটা প্রশ্নবোধক থেকে যেতে পারে।
এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক