গত এপ্রিলে একটি সংসদীয় বিতর্কের সময় আমি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আমার উদ্বেগের কথা বলেছিলাম। আমার কথায় সবাই বেজার মুখে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ মাসের ঘটনা আমার যুক্তিগুলোকে অনেক জোরালো করেছে।
বিতর্কটি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করতে ভারত যে অনীহা প্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে আমি সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করেছি, ভারত ঐতিহাসিকভাবে প্রতিরক্ষা সরবরাহ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য ক্রেমলিনের ওপর নির্ভরশীল।
এ ছাড়া কাশ্মীর সমস্যা কিংবা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে যে দীর্ঘস্থায়ী সমর্থন পেয়ে আসছে, আমি তারও প্রশংসা করেছি। কিন্তু আমি উল্লেখ করেছি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পশ্চিমের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে যথেষ্ট দুর্বল করেছে।
আমি যুক্তি দিয়েছিলাম, রাশিয়ার অবস্থা যে আরও খারাপ অবস্থায় নেমেছে, তা এই যুদ্ধে তার প্রধান বৈশ্বিক অংশীদার হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়।
এই যুদ্ধ চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতাকে সামনে তুলে ধরেছে এবং সেই নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, ততই রাশিয়ার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে দেবে। এ অবস্থায় চীনের আগ্রাসন মোকাবিলায় ভারত তখন খুব কমই ক্রেমলিনের ওপর নির্ভর করতে পারবে। ২০২০ সালের জুনে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় জওয়ানকে হত্যা করে পিপলস লিবারেশন আর্মি যখন ভারতীয় সীমান্ত দখলের চেষ্টা করেছিল, তখন আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমার রাশিয়ান (এবং রাশিয়াভক্ত) বন্ধুরা আমার রাশিয়ার ক্ষমতা হ্রাসসংক্রান্ত ভয়কে অহেতুক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশ্বকে তাদের কথা বিশ্বাস করানোর জন্য যেসব খবর প্রচার করছে, তাতে রাশিয়াকে খাটো করার চেষ্টা রয়েছে। তারা রাশিয়ার অবস্থা সম্পর্কে যে ধারণা দিচ্ছে, প্রকৃত অবস্থা হলো, তারা তার চেয়ে অনেক ভালো করছে।
চীনের গগনবিহারী উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাশ টেনে ধরতে ভারতকে অবশ্যই অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে। চীন ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ভ্রাম্যমাণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আদলে নিজেকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করছে এবং তার সেই প্রচেষ্টায় ক্রমবর্ধমানভাবে যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্য অংশীদার হয়ে উঠছে। ভারতের সীমান্ত এলাকাজুড়ে চীন-পাকিস্তান চক্রের তৎপরতা ভারতকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ভারত ছাড় পাওয়া দামে রাশিয়া থেকে তেল ও সার কেনা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারত ৩০ শতাংশ মূল্য ছাড়ে রাশিয়া থেকে তেল কেনা শুরু করেছিল এবং সেই ছাড়ের পরিমাণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু এর মধ্যে ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, চীন ও রাশিয়া প্রকৃতপক্ষে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর করছে বলে মনে হচ্ছে, যা উভয় দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে অস্বস্তিকর পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দুই দেশের মধ্যে ‘সীমাহীন’ অংশীদারির ঘোষণা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে উভয় দেশই বারবার তাদের ভূরাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করে যাচ্ছে।
গত মাসে পুতিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে তাইওয়ান সফরের অনুমতি দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে সমর্থন করার পথ নয়, এটি নির্জলা উসকানি।’
এর এক সপ্তাহ পরে চীন রাশিয়ার পক্ষে সাফাই দেয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ায় চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং হানহুই যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ইউক্রেন সংকটের সূচনাকারী এবং প্রধান উসকানিদাতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ সামলাতে গিয়ে রাশিয়া রপ্তানি বাজার এবং গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের উৎস হিসেবে চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া থেকে চীনা আমদানি ৫৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে চীনই একমাত্র দেশ যে রাশিয়ানদের এমন সব ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করতে পারে, যা একসময় রাশিয়া ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করত।
এর মধ্য দিয়ে চীন তার লাভ বুঝে নিচ্ছে। কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পশ্চিমাদের ভয়ে ভীত নন—এমন একটি ভাবমূর্তি জোরালো করতে পারছেন। একই সময়ে তিনি রাশিয়ার বাজারে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এবং চীনা মুদ্রা রেনমিনবির বর্ধিত মর্যাদা থেকে উপকৃত হচ্ছেন।
এই পটভূমিতে, ভারতকে অবশ্যই তার ভূরাজনৈতিক বিকল্পগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে হবে। ভারত এটি অবশ্যই স্বীকার করবে, রাশিয়াকে তার কখনোই কম প্রয়োজনীয় মিত্র মনে হয়নি। তবে রাশিয়ান সামরিক সরবরাহের ওপর ভারতের নির্ভরতা অনেক কমে গেছে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অস্ত্র সরঞ্জামের ওপর ভারত ৭৫ শতাংশ নির্ভর করত। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সেই হার ৫০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে এই হার আনুমানিক ৪৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
এটি ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েল প্রধান সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী হয়ে ওঠায় ভারতের অস্ত্র ক্রয়ের বাজার বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চীনের গগনবিহারী উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাশ টেনে ধরতে ভারতকে অবশ্যই অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে। চীন ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ভ্রাম্যমাণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আদলে নিজেকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করছে এবং তার সেই প্রচেষ্টায় ক্রমবর্ধমানভাবে যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্য অংশীদার হয়ে উঠছে। ভারতের সীমান্ত এলাকাজুড়ে চীন-পাকিস্তান চক্রের তৎপরতা ভারতকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ নতুন ভূরাজনৈতিক ফল্ট লাইন তৈরি করেছে। এ কারণে ওই অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় নিজস্ব কঠিন কৌশলগত নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ভারতকেও একই পথে এগোতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। বর্তমানে তিনি ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি