সম্প্রতি কুড়িগ্রামের চর এলাকার একটি বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্রী বলল, ‘আমরা বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক নিয়ে এলাকার মানুষকে সচেতন করি, কয়েকটি বিয়ে বন্ধ করেছি।’ তারা যখন প্রথম শ্রেণিতে, তখন প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে তাদের অর্ধেকই নেই। নদীভাঙনের কারণে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। তাদের কয়জন বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে, কে জানে? যারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি, তাদের বেশির ভাগই হয়তো মেয়ে। তাদের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে কি না, তার খবর কেউ রাখে?
বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে মেয়েদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়। বেশির ভাগ পরিবার ছেলেদের লেখাপড়ায় বিনিয়োগে উৎসাহী। ঘরের কাজ ও ভাইবোনদের যত্নেও মেয়েদের সহায়তা করতে হয়। ফলে অনেকে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে এবং পরবর্তী সময় ঝরে পড়ে। তা ছাড়া বাল্যবিবাহ মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা।
২০২৪-এর মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৪১ দশমিক ৬। ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: এ প্রোফাইল অব প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’ জানাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক।
বিয়ের পর কিশোরীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। মা হওয়ার সময়েও একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় তারা অধিক ঝুঁকিতে থাকে। বিবাহিত মেয়ে এবং কিশোরী মেয়েদের বিদ্যালয়ে ফেরাকে নিরুৎসাহিত করে পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ। ফলে বাল্যবিবাহে মেয়েদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। মেয়েরা তাদের সম্ভাবনা বিকাশের কোনো সুযোগ পায় না।
দারিদ্র্য, কিশোরীদের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাসহ বাল্যবিবাহের অনেক কারণ আছে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও প্রধান একটা সমস্যা। শিক্ষার সঙ্গে বাল্যবিবাহের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে যেসব মেয়ে অন্তত ১০ বছর বিদ্যালয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা হলেও কম। যারা ১২ বছর বিদ্যালয়ে যেতে পেরেছে, তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৫০-এ কমে গেছে। মেয়েদের পড়াশোনার অধিকার আছে। তা ছাড়া শিক্ষা অব্যাহত থাকলে বাল্যবিবাহের হারও কমে। যদিও গত এক দশকে বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বেড়েছে, তবু অসংখ্য মেয়ে এখনো প্রাথমিক শিক্ষার পর ঝরে পড়ছে। জলবায়ু সংকটের কারণে মেয়েশিক্ষার্থীদের ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।
জলবায়ু সংকট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেয়েদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে। পরিবার যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে, তখন মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও বাল্যবিবাহের মিলিত প্রভাবে মেয়েদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই ঝুঁকির ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ দেশ হলো বাংলাদেশ, বুরকিনা ফাসো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ, গিনি, মালাউই, মালি, মোজাম্বিক, নাইজার ও দক্ষিণ সুদান (গ্লোবাল গার্লহুড রিপোর্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন, ২০২৩)।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ওপর জলবায়ু সংকটের প্রভাব নিয়ে তথ্য-উপাত্তের অভাব আছে। তবে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোয় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
দুর্যোগে শ্রেণিকক্ষ বিধ্বস্ত হয় এবং কখনো কখনো তা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে দুর্যোগে শিশুদের লেখাপড়া ব্যাহত হওয়া আমাদের দেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দুর্যোগে অনেকে ঘরবাড়ি হারায়; জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে। অভিভাবকেরা আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে বাল্যবিবাহকে টিকে থাকার একটি কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেন। মেয়েদের ঘরের কাজের দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া, বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে যেকোনো দুর্যোগের পর সাধারণত বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগামী বছরগুলোয় আরও ঘন ঘন এবং আগের চেয়ে তীব্র হয়ে উঠতে পারে। এর লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে—দুর্যোগের প্রকোপ বেড়েছে। জল, হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ অধিক হুমকির মুখে। মেয়েদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
করোনা মহামারির সময় দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিবাহ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অসংখ্য মেয়ের পড়াশোনার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। জলবায়ু সংকট যাতে মেয়েদের পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, তা নিশ্চিতকরণে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষক, মা-বাবাসহ সমাজের সবাইকে নিজের দায়িত্ব পালনে গতি আনতে হবে।
করণীয় কী
জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কর্মসূচিগুলোয় কিশোরী মেয়েদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জেন্ডার সংবেদনশীল দূরশিক্ষণ কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা—এর ফলে দুর্যোগের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও মেয়েরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। ভবিষ্যতে বিদ্যালয় নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ‘ইন্টার-এজেন্সি নেটওয়ার্ক ফর এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সি গাইডেন্স অন সেফার স্কুল কনস্ট্রাকশন’-এর দিকনির্দেশনা মেনে চললে দুর্যোগে বিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা করা সম্ভবপর হবে।
জলবায়ু সংকটজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে পারিবারিক দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় যাতে মা-বাবা মেয়ের বিয়ে না দেন, সে জন্য মেয়েশিশু আছে, এমন পরিবারগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা। প্রয়োজনে তাদের নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া।
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষায় মেয়েদের অধিকারের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহকে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত অভিযোজন এবং ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমে মেয়েদের মতামত শোনা এবং তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করা।
বাংলাদেশের মেয়েরা পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চায়। জলবায়ু সংকটের সময় তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী