গুজব না ছড়াতে চাইলে আগে ইন্টারনেট খুলে দিন

সরকারি মহল থেকে কয়েকদিন ধরে বারবার বলা হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলন নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে; গুজবে কান দেবেন না। কিন্তু গুজবে কান না দিয়ে আসলে ঘটনা কী ঘটেছে বা ঘটছে তা যাচাই করব যে মোক্ষম মাধ্যমটা ব্যবহার করে, সেই মোবাইল ইন্টারনেটের ফোর-জি সেবাটাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক নয়টা পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বা ওয়াইফাই সংযোগ চালু ছিল। এরপর থেকে সেটিও পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই ঘটনা ঘটে মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও।

ফলে সব ধরনের ইন্টারনেট মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারসহ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিসেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

গত বুধবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে সংঘর্ষে এবং পুলিশ ও সরকারের অনুগত বাহিনীর হামলায় ছয়জন নিহত হওয়ার পর রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পরদিন বৃহস্পতিবার দিনের বেলায়ও দেশের অনেক জায়গায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ধীরগতির ছিল। তবে ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই সংযোগের কারণে মানুষ খবরাখবর জানতে পারছিল। সন্ধ্যার পর হতে ব্রডব্যান্ড ইন্টানেটও ধীরে ধীরে ধীরগতি হতে থাকে। পরবর্তীতে সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা একবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটেছে। মোবাইল খুলে দেশের কোথায় কী ঘটছে, তা পুরোপুরি জানার কোনো উপায় ছিল না। সংবাদমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইটেও ঢুকতে না পারায় পাঠক সংবাদমাধ্যমের অফিসে ও সংবাদকর্মীদের ফোন করে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

শুক্রবার সকাল থেকে কিছু জায়গায় ব্রডব্যান্ড সেবা চালু হলেও তা খুবই ধীরগতির। তবে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধই আছে। ফলে একমাত্র টেলিভিশন সম্প্রচার ছাড়া সারাদেশের মানুষ এখনো দেশে কী ঘটছে তা নিয়ে কোনো তথ্য পাচ্ছে না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকতে না পারায় তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই পাচ্ছে না।

গত দশ বছর ধরে সরকারি প্রভাবের কারণে দেশের অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেলের দেওয়া খবরের ওপর মানুষের আস্থা কতটা কমেছে, তা না বললেও চলে। এই অবস্থার মধ্যেও অন্তত কিছু নিউজ পোর্টালের দেওয়া তথ্যের ওপর মানুষ ভরসা করে। যে কোনো খবরের সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হতে ওই সব নিউজ চ্যানেল মানুষ দেখতে পারে।

কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় কোথায় কী ঘটছে তা সঙ্গে সঙ্গে জানার কোনো উপায় নেই। গতকাল সারা দিন ধরে কী ঘটেছে, আজ সকাল থেকে কী ঘটছে তা নিয়ে আমরা মোটাদাগে অন্ধকারে আছি। আর এই অন্ধকারই হলো গুজবের আঁতুড় ঘর। শুধু গুজব নয়, অপতথ্য ও ভুল তথ্যের ছড়াছড়ির দুয়ারও খুলে যায় এ সময়।

সংঘর্ষ ও হামলায় নিহত হওয়ার সংখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকম। কোথাও আগুন ধরানো হয়েছে, কোথাও কত জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে তা নিয়েও নানা তথ্যের ছড়াছড়ি।

এই সব অসমর্থিত ভাষ্য কোনো নিশ্চিত খবর না। তার মানে, এগুলো গুজব বা ভুল তথ্য। এসব ‘গুজবে’ কান দিতে না করা হচ্ছে। তাহলে সত্যিকার খবর জানতে কী আমরা বিটিভি খুলব? তাতে কোনো ফায়দা হবে? এখন তো সেখানেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা।

ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢোকা যাচ্ছে না। খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু থাকলেও অনেক জায়গায় সংযোগ পেতে সমস্যা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে পত্রপত্রিকাতেও আগের দিনের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা জানা যাচ্ছে একেক রকম। ফলে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে শুনতে হচ্ছে, গুজবে কান দেবেন না।

মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) সচিবালয়ে সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গুজব ছড়ানো হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, এসব অপপ্রচার ও গুজব ঠেকাতে ফেসবুক, টিকটকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে তাঁরা সহযোগিতা চেয়েছেন। সেই কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না মিললে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হয়তো সেই ‘ব্যবস্থা’ হিসেবে ফোর-জি ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা অপতথ্য ছড়ায়—এ কথা ঠিক। কিন্তু এই অজুহাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়াটা তো মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল।

কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়ালে, সেটি যাচাই করে দেখার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম ইন্টারনেট। ভিডিও বা অডিও কল থেকে ঘটনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু যখন কোনো তথ্যই পাওয়ার পন্থা সামনে খোলা থাকে না, তখনই গুজব ডালপালা মেলে। তখনই তিল তাল হয়ে যায়।

সরকার কি ভুলে গেছে, ইন্টারনেট সেবা এখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে? তারা কি জানে না লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর রুটি-রুজি ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পর্কিত?

নিউইয়র্কভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অ্যাকসেস নাউ এবং ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম কিপইটঅন কোয়ালিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের দিক থেকে সারা বিশ্বের জন্য ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে খারাপ বছর।

সহিংসতা, যুদ্ধাপরাধ ও গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ এবং অন্যান্য নৃশংসতা দমন করতে বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ করেছিল। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১ তম। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভিন্নমত দমনে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার ২০২৩ সালে যে তিনবার ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছে, তা রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন ও বিরোধী দলগুলোর সমাবেশের সময় এবং প্রধানত রাজধানীতে।

তবে এবার সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো।

২.

হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। বড় চাচা ড. আসগরের চরিত্রে ছিলেন আলী যাকের। তিনি জানালা দরজা আটকে ঘরে বসে থাকেন। ঘরের ভেতরে তিনি কী করছেন তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। তিনি ভেতরে কী করেন তাই দেখার জন্য বাড়ির কাজের লোক মতি মিয়ার বিরাট কৌতূহল জাগে। সে দরজার ফুটোয় চোখ রেখে ভেতরে কী হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করে।

ড. আসগর টের পেয়ে ফুটোয় পিচকিরি রেখে মতি মিয়ার চোখে কালি মারেন। তাতেও মতি মিয়া দমে না। ড. আসগর আবার দরজা আটকে দিলে আবারও সে ফুটো ধরে। তিনি মতি মিয়ার এই ‘ফুটো ধরা’ অভ্যাস নিয়ে মহা সমস্যায় পড়েন।

ড. আসগর তাদের বাড়িতে আসা মীরার (সুবর্ণা মুস্তফা) কাছে এর সমাধান চাইলে মীরা তাঁকে ঘরের সব জানালা খুলে রাখতে বলেন। মীরা বলেন, মানুষের কৌতূহল দুর্দমনীয়। তাকে চাপা দিতে গেলে তা আরও বেড়ে যায়। কৌতূহলের প্রশমন না হলেই গুজবের জন্ম হয়।

আমরা গুজব চাই না। গুজবে কান দিতে চাই না। আমরা প্রকৃত তথ্য ও সত্য জানতে চাই। এক্ষুনি ইন্টারনেট খুলে দিন।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    ই–মেইল: [email protected]