ট্রাম্প জিতলে কী হবে, সেই শঙ্কায় ইউরোপ

২০১৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা উক্তি ভাবনায় ফেলেছিল ইউরোপকেছবি: এএফপি

নির্বাচন হবে যুক্তরাষ্ট্রে। তবে তা নিয়ে মাথাব্যথা আর শঙ্কা বিশ্বজুড়ে। সবার প্রশ্ন, নির্বাচনে জিতবে কে? ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস?

যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ওপর কেবল আমেরিকানদের ভাগ্যই নির্ভর করছে না। এই নির্বাচন মার্কিন নাগরিকসহ ইউরোপ, চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং গ্লোবাল সাউথ এমনকি বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্যরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতেরা কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্রাসেলসে ইইউ ওয়ার্কিং গ্রুপগুলো নীতিনির্ধারণ নিয়ে বৈঠক করছেন।

মূল আলোচ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল কীভাবে মোকাবিলা এবং কীভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায়।

জার্মানির একটি সংবাদমাধ্যমে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইইউ কূটনীতিক জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে প্রস্তুতি সভাগুলোর মূল লক্ষ্য হলো, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তানীতিকে যতটা সম্ভব ‘ট্রাম্প-প্রুফ’ হিসেবে তৈরি করা।

আরও পড়ুন

উদাহরণস্বরূপ, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর ইউরোপ থেকে আসা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেন, তবে তাঁরাও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণা সভাগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা অভিযোগের দীর্ঘ তালিকায় ইউরোপ উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে।

তিনি বলেছেন, ‘তারা আমাদের গাড়ি নেয় না, তারা আমাদের কৃষিপণ্য নেয় না, তারা কিছুই নেয় না।’ তিনি ইইউকে ‘মিনি চীন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ট্রাম্পের বিশ্বদর্শনে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউরোপকে চীনের পর্যায়ে ফেলতে যাচ্ছে।

জার্মানির অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা ‘হ্যান্ডেল ব্লাট’ জানিয়েছে, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা ইউরোপের জন্য একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ধাক্কা হিসেবে দেখা দেবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন কূটনীতিক বলেছেন, ‘বাণিজ্যঘাটতি নিয়ে ট্রাম্পের একটা ভাবাবেগ আছে। তিনি আমাদের ইউরোপিয়ানদের উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করবেন, আমাদের বিভক্ত করবেন, আমাদের দুর্বল করার চেষ্টা করবেন।’

আরও পড়ুন

ট্রাম্প সম্প্রতি ইউরোপীয় সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। বর্তমানে প্রযোজ্য রয়েছে ১ থেকে ২ শতাংশ শুল্ক।

আর চীন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানের শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৬০ শতাংশ করার হুমকি দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। তাই ট্রাম্পের বিজয় ইউরোপের জন্য অর্থনৈতিকভাবেও বিপজ্জনক হবে, বিশেষ করে তা মার্কিন মুলুকে বড় রপ্তানিকারক দেশ জার্মানির জন্য।

এই নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে জার্মানির অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার গত সপ্তাহে ইউরো-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে ইইউ সদর দপ্তর ব্রাসেলসেও উদ্বেগ বাড়ছে এবং জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি চলছে। যে মুহূর্তে এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেই সময় ইউরোপ নানা সংকটে জর্জরিত।

আরও পড়ুন

দুই বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভার, নানা দেশে দক্ষিণপন্থীদের আস্ফালন ও জনপ্রিয়তা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই বড় দেশ জার্মানি ও ফ্রান্সের ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তাই ক্রমশ অধোগতি মানুষকে ভাবাচ্ছে।

ট্রাম্প যদি জয়লাভ করেন, তা হবে ইউরোপের জন্য বড় ধাক্কা। ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অস্তিত্বের পরীক্ষায় ফেলতে পারে।

বিশেষ করে এ সময় ইউরোপে শক্তিশালী ডানপন্থী পপুলিস্ট গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি রয়েছে, ফলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে ইউরোপিয়ানদের কাজ করা আরও কঠিন করে তুলবে।

বর্তমানে ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হলেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান। ইউরোপে তিনি সবচেয়ে ট্রাম্প–ভক্ত বলে পরিচিত।

এ বছর গ্রীষ্মে তিনি কিয়েভ, মস্কো, বেইজিং এবং ফ্লোরিডার পাম বিচে ট্রাম্পের বাসভবনে ‘শান্তি মিশনে’ গিয়েছিলেন। তাঁর এই সফর নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক দোলাচল, পাশাপাশি দেশে দেশে কট্টরপন্থীদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় সংশয়ে পড়েছে ইউরোপীয় রাজনীতি। ২০১৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা উক্তি ভাবনায় ফেলেছিল ইউরোপকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত প্রায় ৮০ বছরের টানা বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্কে হঠাৎ করেই সংকট দেখা দিয়েছিল।

তবে ওরবান তাঁকে নিয়ে সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন।

রাশিয়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ওরবানের দল ফিদেজের সদস্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য আন্দ্রাস লাজলো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমেরিকানরা মার্কিন রাজনীতিতে পরিবর্তন চান, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পরিবর্তন এনে দিতে পারেন।’

ব্রাসেলসেও ইইউতে পরিবর্তন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

অবশ্য এ ধরনের মতামত ইইউ ও ন্যাটোর সরকারপ্রধানদের মধ্যে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের বা তাঁর দলের অনুসারীদের।

তবে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে ইতালি পর্যন্ত অনেক ডানপন্থী চরমপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদেরা ওরবানের সঙ্গে একমত। নির্বাচনে তাঁরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় হলে উৎসাহ বোধ করবেন।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, জার্মান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের ডেভিড ম্যাকঅ্যালিস্টার মার্কিন নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন।

বৈদেশিক নীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এই রাজনীতিক বলেছেন, ‘কূটনৈতিক নীতিটিই মূলত প্রযোজ্য। আমাদের নির্বাচনের যেকোনো ফলাফলের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

হোয়াইট হাউসে যে–ই আসুক না কেন, আমাদের নিজস্ব স্বার্থে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যতটা সম্ভব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখব।’

কিন্তু ডোনান্ড ট্রাম্পের নির্বাচনপূর্ব বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না ইউরোপের মূলধারার রাজনীতিকেরা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক দোলাচল, পাশাপাশি দেশে দেশে কট্টরপন্থীদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় সংশয়ে পড়েছে ইউরোপীয় রাজনীতি।

২০১৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা উক্তি ভাবনায় ফেলেছিল ইউরোপকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত প্রায় ৮০ বছরের টানা বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্কে হঠাৎ করেই সংকট দেখা দিয়েছিল।

সেই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি যৌথভাবে ইউরোপের দুটি পত্রিকা জার্মানির ‘বিল্ড’ ও ব্রিটেনের ‘দ্য টাইমস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য, ইউরোপ-আমেরিকার ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে সংশয়ের মুখে পড়েছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়বে বলে অভিহিত করেছিলেন।

এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জার্মানির স্বার্থের বাহন বলে উল্লেখ করেছিলেন।

৫ নভেম্বরে ৪৭তম মার্কিন নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প যে–ই জয়লাভ করুক না কেন, তাঁদের ইউরোপ-আমেরিকা ভাবনা কতটা এগিয়ে যাবে, তা দেখতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
    [email protected]