ন্যায়বিচার ও জনস্বার্থ মামলা: প্রান্তজনের মানবাধিকার

বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরে লিগ্যাল প্লুরালিজম বা আইনি বহুত্ববাদ খুব বেশি আলোচিত হয় না। আইনি বহুত্ববাদ হলো, এমন একটি সমাজ যেখানে একই ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে একাধিক আইনি ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে।

এ ব্যবস্থা প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে চলছে এখনও, যেখানে ঔপনিবেশিক আইন আর প্রচলিত আইন (প্রথাগত আইন ও ধর্মীয় আইন ) পাশাপাশি থাকতে পারে। আইনি বহুত্ববাদকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে জনস্বার্থ মামলার মতো আধুনিক আইনি ধারণা গ্রহণ করেছে অনেক উন্নয়নশীল দেশ, বাংলাদেশ এর অন্যতম। এর ধারাবাহিকতায় জনস্বার্থ মামলা ঠিক  ঔপনিবেশিক সূত্রে পাওয়া তা বলা যাবে না। কিন্তু যেসব দেশ উপনিবেশ স্থাপন করতো (যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) সেসব দেশ থেকে এর উৎপত্তি ও বিবর্তন।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) পরার্থ প্রত্যয়ে জনস্বার্থ নিয়ে কাজ করছে এবং প্রতি বছর একটি ফ্ল্যাগশিপ ওয়ার্কশপ করে আসছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জনাব নিজামুল হক নাসিম, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জনাব  মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ-আইনজীবীদের উপস্থিতিতে আরেকটি ওয়ার্কশপ হয়ে গেল নতুন প্রজন্মের আইনজীবী প্রস্তুত করার মানসে। কিছু আইনজীবী অংশ নেন এতে।

‘জনস্বার্থ’ শব্দটির সুলভ এবং সুললিত ধারণা দিয়েছেন ভারতের বিচারপতি সি জে মহাজন। তিনি বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর মামলার রায়ে লেখেন, ‘জনস্বার্থ’ ধারণাটির কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয়। এর কোনো স্থির অর্থ নেই, বরং এটি সম্প্রসারণশীল এবং একেক দেশে এই শব্দটির একেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। সুতরাং ‘জনস্বার্থ’ ধারণাটির এমন কোনো পূর্ব নির্ধারিত পরিধি বা সীমারেখা নেই, যার মধ্যে পড়লেই কেবলমাত্র কোনো বিষয়বস্তু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলে পরিগণিত হতে পারে। প্রত্যেকটি মামলার প্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে তার বিষয়বস্তু জনস্বার্থমূলক হবে কিনা।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় জনস্বার্থ মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার উল্লেখ করে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আইনের শাসন ও জনস্বার্থ মামলার নাড়ির সম্পর্ক। বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নারী অধিকার, পাহাড় রক্ষা, পাথর উত্তোলন বন্ধ করা, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ভূমি-শিশু-প্রতিবন্ধী অধিকার অনেক বিষয় নিয়ে জনস্বার্থে মামলা হয়। জনস্বার্থ নিয়ে আমরা সর্বোচ্চ আদালতে যাই। আদালতই আমাদের শেষ ভরসা।’
জনস্বার্থ মামলার দর্শনটি আইন শাস্ত্রের ভিন্ন একদিকে আলো ফেলে, যে কারণে এটি গণতন্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার চান কি না, সেই বিবেচনা তাঁর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে বাধা বলে গণ্য হতে পারে না, এই কথাটি ন্যায্যতার প্রেক্ষিতে অনস্বীকার্য।

জনস্বার্থ মামলা আর পরিবেশ যেন প্রায় সমার্থকতায় উন্নীত হয়েছে। পরিবেশ ইস্যুতে বেশ কিছু যুগান্তকারী রায় নজির সংহিতায় স্থান করে নিয়েছে। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো.আশরাফুল কামালের বেঞ্চ ১৩৯৮৯/২০১৬ রিট পিটিশনের রায়ে উল্লেখ করেন, নদীর জীবনসত্তার বিষয়টি।

অন্য একটি মামলায় উচ্চ আদালত মত প্রকাশ করেন যে, আইনসভা ইকোসাইড (বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি) অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারে। আদালত এমন অভিমতও প্রকাশ করেন যে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩-এ ইকোসাইড অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ও গ্লোবাল সিভিল সোসাইটির তৎপরতার প্রেক্ষিতে ইকোসাইড নিয়ে  উচ্চ আদালত এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেন। ঝিনাইদহের নবগঙ্গা নদীতে বাঁধ অপসারণের নির্দেশ দেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ । এভাবেই বিচারপতিগণ পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

ফ্যাপ-২০ সংক্রান্ত ড. মোহিউদ্দিন ফারূকের মামলায় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের যেন ক্ষতি না হয় সে সম্পর্কে আদালত অভিমত দেন। এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিন-এর আওতায় প্রাকৃতিক সম্পদ (আসলে যা জনসম্পত্তি), তার সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত জনস্বার্থ মামলায়, বলে অভিমত দেন ড. সাইফুল করিম, প্রফেসর কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া।

আমাদের দেশেও হরাইজন্টাল অ্যাপ্রোচ নিয়ে আদালত প্রতিকারের দরজা খুলেছে। হরাইজন্টাল এনফোর্সমেন্ট অফ ফান্ডামেন্টাল রাইটস এর ধারণা বা তত্ত্ব (ভার্টিক্যাল অ্যাপ্রোচ যা সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে  প্রযোজ্য) ব্যবহার  করে বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে সংবিধানের অনুচ্ছদ ১০২(২) এর আওতায় প্রতিকার প্রাপ্তির প্রথম উদাহরণ রোকেয়া আক্তার মামলা।

বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা বৃহত্তর সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নাগরিক অধিকারবোধকে যে প্রসারিত করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আইনশাস্ত্রের নবতর সংযোজন  জনস্বার্থ মামলা। অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়া সত্ত্বেও বিচার বিভাগ, ব্যবহারজীবী ও আইনশাস্ত্রবিদদের যৌথতায় জনস্বার্থ লঙ্ঘনের প্রতিবিধানে কার্যকর এক নিদান ।

বিশ্বায়নের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য মিলিতকরণ। এই মিলিতকরণ তত্ত্ব (থিওরি অফ কনভার্জেন্স) মেনে আধিরাষ্ট্রিক আইন ব্যবস্থা (সুপ্রা ন্যাশনাল লিগ্যাল সিস্টেম) হয়ে উঠবে এই পৃথিবী এ এক স্বপ্ন । আধিরাষ্ট্রিক আইন ব্যবস্থা বাস্তব  হলে বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা পীড়িত মানুষের জন্য ডাবলিনের কোনো সংবেদী সংগঠন কিংবা ম্রো জাতি গোষ্ঠীর পাহাড় নির্ভরশীল জীবন-জীবিকা বিনাশী বাণিজ্যিক ইকো প্রজেক্টের বিরুদ্ধে জোহানেসবার্গের কোন জনসমষ্টি সহৃদয়তা দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের মতো কোনো বৈশ্বিক ফোরামে প্রতিকার চেয়ে জনস্বার্থ মামলা করতেই পারে। এতে  বৈশ্বিক মানবাধিকারই সমুন্নত হবে।  

স্বার্থান্ধ এই পৃথিবীতে এখনো আশ্চর্য সব মায়ার মানুষ আছেন। জনস্বার্থ নিয়ে ভাবেন। যে কারণে ইসরায়েলের গাজা গণহত্যার বিচার চেয়ে মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। জনস্বার্থ ধারণ করতে দুটো দৃশ্য কল্পনা করুন তো—ঢাকায় কোনো সম্পন্ন পরিবারের বাবা যখন সকালের নাশতায় কমলার জুস খেতে না চাওয়ায় অভিমান করেন সন্তানের ওপর, ঠিক তখন গাজা কিংবা রাফায় ফিলিস্তিনি কোনো বাবা কাফনে মোড়া প্রিয় সন্তানের কপালে এঁকে দিচ্ছেন পৃথিবীর শেষ চুম্বন।    

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
    [email protected]