পাকিস্তানে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে জনগণের রায়সূচক নির্বাচন হিসেবে নেওয়া প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে যে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান ইমরান খানকে গদিতে বসতে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠান এখন সাইফার (সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে আদান-প্রদান করা চিঠি বা তারবার্তার নথি) মামলা, তোষাখানা মামলা এবং ইদ্দত মামলা দিয়ে তাঁকে শুধু শায়েস্তা করতেই চাচ্ছে না, বরং তাঁর দলকে পুরোপুরি ধ্বংস করার এবং দলটির যাবতীয় নির্বাচনী সম্ভাবনাকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এখানেই শেষ নয়। সেই পর্দার আড়ালের শক্তি এক সময় যে ব্যক্তির রাজনৈতিক পদে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, তাঁকেই এখন চতুর্থ মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানোর নিশ্চয়তা দিচ্ছে।
নওয়াজ শরিফের আরেক দফা পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে—এই বিষয়টি তিনি নিজে বুঝতে পারছেন কিনা তা যে কাউকে ভাবাতে পারে। যদি তাঁর দল পিএমএল-এন (পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ) জয়লাভ করেও, তবু তার সেই জয়ের বৈধতা গোড়া থেকেই ক্ষুণ্ন হবে।
ইমরানের বিপর্যস্ত স্ত্রী বুশরা বিবির মতো আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না। কিন্তু এটুকু আন্দাজ করতে পারি, সামরিক গোষ্ঠী যতক্ষণ না গণতন্ত্রকে চলার সুযোগ করে দিচ্ছে ততক্ষণ পাকিস্তানের উন্নতি হবে না। যতক্ষণ জনগণকে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না, ততক্ষণ ভর দুপুরেও অন্ধকার থাকবে।
গণতন্ত্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত। দেশটি স্বাধীন হওয়ার ২৩ বছরের মধ্যে সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ একই সঙ্গে স্বাধীন হওয়া ভারত ১৯৫১-৫২ সালেই নির্বাচন আয়োজন করেছিল। পাকিস্তান পঞ্চাশের দশক শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনের পথে হাঁটতে চেয়েছিল। কিন্তু একজন জেনারেলের (পরে তিনি ফিল্ড মার্শাল হন) নেতৃত্বে প্রথম সংঘটিত অভ্যুত্থানের কারণে সেই পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। আইয়ুব খান নামের সেই জেনারেল পাকিস্তানের আবহাওয়াকে গণতন্ত্রের জন্য অনুপযুক্ত বলে মনে করতেন।
আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও জুলফিকার আলি ভুট্টোর (তাঁর দল পিপিপি পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেছে) যোগসাজশে সামরিক শাসকেরা ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ম্যাকিয়াভেলিয়ান কায়দায় ছলচাতুরী করে হলেও, ভুট্টো প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উচ্চ আশার প্রথম ভান্ডার। যদিও সেই উচ্চ প্রত্যাশার খুব সামান্যই তিনি পূরণ করতে পেরেছিলেন।
১৯৭৭ সালের নির্বাচন ভুট্টোর ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছিল। সরকার ও বিরোধী দলের বাদানুবাদের মুখে সামরিক বাহিনী পরিস্থিতি সামলাতে হস্তক্ষেপ করে এবং বিতর্কিত নির্বাচনের পুনরায় নির্বাচন দিতে চেয়েছিল।
জাতির সামনে তখন সবচেয়ে অন্ধকার সময় ঘনিয়ে আসছিল। এরপর কালো মেঘ জাতিকে ছেয়ে ফেলল। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়াউল হক মারা না যাওয়া পর্যন্ত সেই কালো মেঘ কাটেনি।
আসলে সেই কালো মেঘের ছায়া কখনোই পাকিস্তানের মাথা থেকে সরেনি। ১৯৮৫ সালের অর্থহীন দলহীন নির্বাচন এমন একটি নির্বাচনী প্যাটার্ন তৈরি করে যেখানে গোষ্ঠীগত আনুগত্য দলীয় রাজনীতিকে ছাপিয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে আইএসআই নওয়াজ শরিফকে পুতুল নেতা হিসেবে তৈরি করতে আইজেআই (ইসলামী জাম্বুরি ইত্তেহাদ)-কে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।
সামরিক গোষ্ঠীর মদদপুষ্ট আইজেআই কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যর্থ হলেও পাঞ্জাবে জয় পায় এবং বেনজির ভুট্টোর ক্ষমতা খর্ব হয়। কয়েক বছরের মধ্যে বেনজিরকে বরখাস্ত করা হয়। তবে ১৯৯৩ সালে নওয়াজকে ঠিক একই ভাগ্য বরণ করতে হয়।
এরপর ফের পিপিপি আসে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আবার নওয়াজকে জিতিয়ে আনা হয়। নওয়াজ ধারণা করেছিলেন, তিনি সামরিক গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে পারবেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এক অভ্যুত্থানে গদি হারিয়ে তাঁর সেই ভুল ভাঙে। পারভেজ মোশাররফ নওয়াজকে উৎখাত করে। নওয়াজ এবং বেনজির দুজনকেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন এবং দুজনকেই রাজনীতি থেকে চিরতরে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। কিন্তু এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে তাদের ফিরে আসতে দিতে তিনি বাধ্য হন।
পাঠককে নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার হবে না, এই দীর্ঘ সময়ে সামরিক গোষ্ঠী কখনোই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিকদের হাতে ছাড়েনি।
তৃতীয় দফায় নওয়াজকে ছুড়ে ফেলার পর তুলনামূলকভাবে রাজনীতির বাইরের লোককে গদিতে বসাতে চেয়েছিল তারা। সে অনুযায়ী, তারা ইমরান খানকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ইমরানকে সরিয়ে দেওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা ছিল প্রত্যাশার চেয়ে কিছু বেশি। সামরিক গোষ্ঠী বুঝতে পারছে, ইমরান এখন জনগণের নেতা হয়ে উঠেছেন।
ইমরানের বিপর্যস্ত স্ত্রী বুশরা বিবির মতো আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না। কিন্তু এটুকু আন্দাজ করতে পারি, সামরিক গোষ্ঠী যতক্ষণ না গণতন্ত্রকে চলার সুযোগ করে দিচ্ছে ততক্ষণ পাকিস্তানের উন্নতি হবে না। যতক্ষণ জনগণকে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না, ততক্ষণ ভর দুপুরেও অন্ধকার থাকবে।
মাহির আলি পাকিস্তানের সাংবাদিক ও লেখক
ডন থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত