হেনরি কিসিঞ্জার ছাড়া চলমান বিশ্বব্যবস্থার কথা কল্পনা করা কঠিন—এটি শুধু এই কারণে নয় যে তিনি ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন। বরং এর কারণ, অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী স্থান দখল করে রেখেছিলেন।
১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্ম নেওয়া কিসিঞ্জার পরিবারের সঙ্গে ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়ে কয়েক বছর পর মার্কিন বাহিনীর সদস্য হিসেবে সেই জার্মানিতে ফিরে এসেছিলেন। সেখান থেকে আমেরিকায় ফিরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র হিসেবে পাঠ নিয়েছেন এবং পরে সেখানকারই একজন অনুষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আট বছর কাজ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সরকারে কিসিঞ্জার প্রথমে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন (১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে যুগপৎভাবে তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন)।
সরকারের দায়িত্ব পালনকালে কিসিঞ্জারের সাফল্য ও অর্জন অনেক। প্রথমত, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের ভাঙনকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ওই সময় কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের কয়েক দশকের বৈরী সম্পর্কের অবসানই শুধু ঘটেছিল তা নয়, বরং তাইওয়ান প্রশ্নে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের একটি সমঝোতা হয়েছিল। এটি চীনের অর্থনৈতিক রূপান্তরের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করেছিল। এই সঙ্গে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি টেকসই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল।
এটির আরও একটি দিক ছিল। সেটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে উত্তেজনা শিথিল। কিসিঞ্জার ও নিক্সন (নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনেও কিসিঞ্জারের কর্মকুশলতার প্রভাব ছিল) সেই যুগের মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্কের কাঠামো ঠিক করেছিলেন।
এই কাঠামো পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছিল; নিজ নিজ মিত্রদের সঙ্গে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ ঠিক করেছিল এবং নিয়মিত সম্মেলনের আয়োজনের সুযোগ তৈরি করেছিল। এর সবই শীতল যুদ্ধকে ‘ঠান্ডা’ রাখতে সাহায্য করেছিল।
কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত ‘সাঁটল’ কূটনীতির কারণেই ওই সময় ইসরায়েল ও আরব দেশগুলো অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয় এবং সেটিই প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উদ্যোগে সম্পাদিত মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
এরপরই আসে মধ্যপ্রাচ্যের কথা। গত ৭ অক্টোবর হামাস যেভাবে ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে, একইভাবে আজ থেকে ৫০ বছর আগে মিসর ও সিরিয়া ইসরায়েলের ওপর হঠাৎ আক্রমণ করেছিল। সে সময় কিসিঞ্জার ও নিক্সন ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দান নিশ্চিত করলেও তাঁরা সে সময় মাত্রাতিরিক্ত সামরিক শক্তি ব্যবহার না করতে ইসরায়েলকে চাপ দিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, ইসরায়েল খুব বেশি বাড়াবাড়ি করলে রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা ওয়াশিংটনের সঙ্গে মস্কোর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত ‘সাঁটল’ কূটনীতির কারণেই ওই সময় ইসরায়েল ও আরব দেশগুলো অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয় এবং সেটিই প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উদ্যোগে সম্পাদিত মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
এসব অর্জনের যেকোনো একটিই একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার রেখে যেতে সক্ষম করার জন্য যথেষ্ট। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার অনেক কিছুই কিসিঞ্জারের এ ধরনের বহু কৃতিত্বের উত্তরাধিকার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিশ্চিতভাবেই তিনি কূটনীতি অনুসরণ করতেন। কিন্তু তাঁর কূটনীতি ছিল এমন, যা ক্ষমতার ভারসাম্যের ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে পরিচালিত হতো। এটি শুধু কূটনীতি ছিল না, এটি ছিল সংযমসঞ্জাত কূটনীতি।
কিসিঞ্জারের আগে-পরে জর্জ মার্শাল, ডিন অ্যাচেসন এবং জেমস বেকারের মতো অনেক চৌকস পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন। কিন্তু একজন নির্বাহী ও বিশ্লেষক হিসেবে কিসিঞ্জারের সঙ্গে তাঁদের কারও তুলনা চলে না। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের বিশিষ্ট জ্ঞানচর্চাকারী কূটনীতিক।
রিচার্ড এন হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত