তালেবানের যে আইন ও নীতি বিভাজন বাড়িয়ে তুলছে

সড়কে নিরাপত্তা ও তল্লাশি কার্যক্রমে তালেবানের নিরাপত্তা বাহিনীফাইল ছবি

আফগানিস্তানে গত ২১ আগস্ট কঠোর জননৈতিকতা আইন চালু হয়েছে। ১১৪ পাতার এই আইনে গণপরিবহন, গণমাধ্যম, সংগীত, জনপরিসর, ব্যক্তিগত পর্যায়—এসব ক্ষেত্রে কী ধরনের আচরণ করা যাবে, তার বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় খড়্গটা নেমে এসেছে সংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা। প্রকাশ্যে মেয়েদের গান গাওয়া ও জোরে পড়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

এই আইন ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক সমালোচনা জন্ম দিয়েছে। নারীদের ওপর বিধিনিষেধ সহজ করার জন্য যে প্রতিশ্রুতি তালেবান সরকার নিয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

প্রকাশ্যে বিরোধিতা না হলেও এই আইন আফগানিস্তানের ভেতরেও অনেক বড় অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। এর কারণে তালেবানের শীর্ষ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে গোষ্ঠীটির সদস্যদের বিভাজন এড়িয়ে ঐক্যকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জননৈতিকতা আইন পাসের মাধ্যমে যে বিষয়টি পরিষ্কার, সেটি হলো তালেবান শাসকেরা আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করেই অতিরক্ষণশীল নীতির দিকে এগোচ্ছে। একই সঙ্গে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এল যে তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।

কান্দাহার বনাম কাবুল

২০২১ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর তালেবান দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতায় বসে। এ সময় তালেবান কর্তাব্যক্তিদের অনেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে দ্বিতীয় তালেবান শাসন প্রথম তালেবান শাসনের উচ্চ রক্ষণশীলতা ও কট্টর আচরণের চেয়ে উদার।

নতুনপন্থীরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষায় কথা বলেছিলেন। নতুন তালেবান সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য এবং বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে রক্ষণশীল নীতি থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসবেন।

যাহোক, অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভা যখন গঠন হলো, তখন প্রথমবার বোঝা গেল সাবেকিপন্থীদের ক্ষমতা কোনোভাবেই খর্ব হয়নি। অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি এবং সাবেকিদের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসানো হলো। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী, সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারকে উপপ্রধানমন্ত্রী এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোহাম্মদ ইয়াকুবকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর মতো কঠিন কাজ হাতে তুলে নিয়েছে, হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তখন কান্দাহারে তাঁর বাসভবনে ক্ষমতার আরেকটি কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তিনি নিজেকে রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় বিষয়ের নেতৃত্ব হিসেবে ঘোষণা করেন।

গত দুই বছরে হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এটা স্পষ্ট করেছেন যে তিনি তাঁর কট্টরপন্থী অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ২০২২ সালের মার্চ মাসে তিনি মাধ্যমিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ও নারীদের পড়াশোনার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।

হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তাঁর নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এবং সরকারের ভেতরে সাবেকিদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি মন্ত্রিসভায় রদবদল করার আদেশ দেন এবং তাঁর অনুগতদের সেখানে নিয়োগ দেন।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল্লাহ মুনিরকে সরিয়ে মৌলভি হাবিবুল্লাহ আগাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি শীর্ষ নেতার খুব ঘনিষ্ঠ একজন। মে মাসে তালেবান সরবারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং একমাত্র টেকনোক্র্যাট সদস্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক কালান্দার ইবাদকে সরিয়ে নূর জালালকে বসানো হয়। নূর জালাল কট্টরপন্থী ও সাবেক উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তালেবানে ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরালো করছেন, তা সত্ত্বেও মাঠে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ক্রমে প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি সরাসরি আখুন্দজাদাকে সমালোচনা করে বলেন, ‘ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ এবং পুরো ব্যবস্থাকে আঘাত করার পরিণাম আমাদের উপকার করবে না...এই পরিস্থিতিকে সহ্য করা হবে না।’

এ বছরের ঈদুল ফিতরের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বাণী দিয়েছেন, সেখানেও তালেবানের নেতৃত্বে বিরোধের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আফগান জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি না করার আহ্বান জানান তিনি।

ঈদের সময় আখুন্দজাদা তালেবান কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান, সব পার্থক্যকে দূরে সরিয়ে দেশকে যথাযথভাবে সেবা করুন। তিনি ঘন ঘন ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং অতি সম্প্রতি উত্তর আফগানিস্তানে বিরল একটা সফরে গিয়ে, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভিন্নমত ও নীরবতা

এর আগেও তালেবান শাসকেরা জননৈতিকতা আইন চালু করেছিলেন কিন্তু তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন তাঁরা করতে পারেননি। এবারের আইনে মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে—তাঁরা এটিকে প্রচার, প্রসার, তদারক করতে পারবেন এবং আইন লঙ্ঘন করলে কাউকে শাস্তি দিতে পারবেন।

নৈতিকতা আইনের এই ঘোষণা প্রমাণ করল যে সর্বোচ্চ নেতার অধীনে নীতি পরিচালনায় সাবেকি তালেবান শাসকেরা কর্তৃত্ব করছেন। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম পর্বের তালেবানের চেয়ে বর্তমান দ্বিতীয় পর্বের শাসকেরা যে আধুনিক নন, এ ঘটনা তার লক্ষণ।

এর আগে যাঁরা দ্বিতীয় তালেবান শাসনের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, তাঁরা মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শান্ত করার জন্য বলেছিলেন, সুনির্দিষ্ট কট্টরপন্থীদের সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু গত এক বছরে কঠোর ধর্মীয় আইন চালুসহ অন্য যেসব কর্মকাণ্ড, তাতে করে এটা স্পষ্ট যে সাবেকিপন্থীরাই তাঁদের অনমনীয় অবস্থান বজায় রেখে নতুনপন্থীদের কণ্ঠ রোধ করছেন।

তালেবান সরকারের রক্ষণশীল নীতি সমর্থন করেন না, এমন কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক তালেবান নেতার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় কয়েকজন আমাকে বলেছেন, তাঁরা তাঁদের পরিবারকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের একজন বলেছেন, তাঁর পরিবার বিদেশে আরও ভালো আছে, ছেলেমেয়েরা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারছে।

ভিন্নমতের লোকদের চুপ করিয়ে দিচ্ছে তালেবান সরকার। কিন্তু এতে করে এখন তাদের যে প্রধান দুটি সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা উত্তরণে কোনো সমাধান দেবে না। সমস্যা দুটি হলো আফগান জনগণের মধ্যে বড়ে চলা অসন্তোষ এবং ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্নতা।

  • লক্ষ্মীবেণু গোপাল মেনন কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গালফ স্টাডিজ সেন্টারের পিএইচডি ক্যান্ডিডেট

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত