আমি খুব আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি, অবশেষে বাংলাদেশের সবাই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবা শুরু করেছেন। এর আগে আমাদের সর্বশেষ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় ২০১২ সালে। আজকে এই পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম নিয়ে যে আলোচনা তৈরি হয়েছে, সেটি জনগণের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা হয়নি।
স্বচ্ছতার স্বার্থে আগেই বলে রাখি, আমি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বেশ ভালোভাবে জড়িত। তিনটি শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তির পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা যৌথ রচনার পাশাপাশি এখন একাধিক বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি দূর থেকেই যতটুকু পারি, বোঝার চেষ্টা করছি ও সে অনুযায়ী বিভিন্ন কমিটিতে আমার সহকর্মীদের পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই লেখাও এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ।
২০২০ সাল থেকে আমি এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। সত্যি কথা বলতে কি, একসঙ্গে এত বেশি মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সঙ্গে এর আগে আমি খুব একটা কাজ করিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই মানুষগুলোকে আমি তিন বছর কাছ থেকে দেখেছি। আমার বিশ্বাস, নতুন শিক্ষাক্রম ঠিকমতো বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁরা তাঁদের সবটুকু চেষ্টা করবেন।
একটি দেশের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা সহজ নয়। কিন্তু আমি যদি এখন জিজ্ঞাসা করি, এটি কতটুকু কঠিন, খুব কম মানুষই সেটির উত্তর দিতে পারবেন। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মানুষ আছে, এমন দেশের সংখ্যা মাত্র সাতটি। আর এই সাত দেশের কোনটিতেই প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মানুষ নেই। এর অর্থ হলো, একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ, যার মাথাপিছু সম্পদ খুব কম, তেমন দেশের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কতটুকু কঠিন, সেটি যদি আমরা বের করতে চাই, বাংলাদেশের নাম থাকবে সবার ওপরে। কাজেই এই উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, আমি তাঁদের সাহসের তারিফ করি।
চ্যাটজিপিটি আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দশকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের একটি অনিবার্য দিক হলো অনলাইনে ছড়ানো অদ্ভুত সব রূপকথা। এটি সত্যি যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি তাদের শিক্ষাক্রম ও শিখন–অভিজ্ঞতা তৈরির সময় বিভিন্ন দেশের উদাহরণ মাথায় রেখেছে।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, আমরা ফিনল্যান্ডের শিক্ষাক্রম চালু করেছি, এটি পুরোপুরি ভুল। যেমন আমি ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। আমি বেশ কিছু দেশের ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যক্রম নিয়ে খোঁজখবর করেছি। কিন্তু আমাদের শিখন–অভিজ্ঞতা, পাঠ্যবই ও শিক্ষক সহায়িকা তৈরি হয়েছে দেশীয় পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে।
একটি নতুন শিক্ষাক্রম যে হয়েছে, এটি সাধারণ মানুষ টের পান যখন তাঁর বাচ্চা প্রথমবার অভিভাবকের কাছে বাড়ির কাজ বুঝতে আসে। আমার মনে হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এখন সময় এসেছে অনলাইনে নানা অপতথ্য ছড়ানোর ভিড়ে বসে না থেকে নিজে থেকে সঠিক তথ্য প্রচার করা। অভিভাবকদের মধ্যে নানাভাবে প্রচারণা চালাতে পারে। এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ সহায়ক হতে পারে।
এখন একটু ভেবে দেখি, এত দিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল? আমি পেশায় বিজ্ঞানী। আশি ও নব্বইয়ের দশকে আমার স্কুল-কলেজের পড়াশোনা ছিল পুরোপুরি মুখস্থনির্ভর। আজ পর্যন্ত এই মুখস্থ করা কোনো কাজে আসেনি। আমি যখন কাজ করি, আমার সামনে বই খোলা থাকে। কাজেই আমি অবাক হই না, যখন দেখি বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক বা গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। স্কুল পর্যায়ের পড়াশোনায় আমাদের অবস্থান ১০৫তম।
সরকার পরিচালিত সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা মূল্যায়নে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির ৬০ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে দুর্বল। তৃতীয় শ্রেণির মাত্র ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির মাত্র অর্ধেক শিক্ষার্থী বাংলা ঠিকমতো বলতে, পড়তে ও লিখতে পারে। উচ্চতর দক্ষতার কথা না হয় বাদই দিলাম।
পদ্মা সেতু যেমন টাকা বাচানোর জন্য এক মাইল কম বানালে হতো না, নতুন শিক্ষাক্রমও তেমনি শিক্ষার্থীদের যেসব যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করার কথা, তার চেয়ে ১ শতাংশ কম যোগ্যতা অর্জন করলেও চলবে না। অথবা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে শিক্ষকদের যে জীবনমান নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তার চেয়ে একটু কম হলেও চলবে না। আমাদের যে লক্ষ্য, সেটিতে পৌঁছাতে হবে। পদ্মা সেতুর চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব ও আন্তরিকতা নিয়ে সেটি করতে হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে আমরা এ–ও জেনেছি, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেটে বা কোচিংয়ে পড়েছে। অভিভাবকদের ওপর চালানো জরিপে জানা গেছে, অষ্টম শ্রেণির ৬৪ শতাংশ ও নবম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসে এ খাতে ১ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ করেছে। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী আর মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গাইড বই পড়ে পরীক্ষা দিতে যায়। এ খাতে অভিভাবকেরা খরচ করেন যথাক্রমে ৬৬৯ টাকা ও ২ হাজার ৬৫ টাকা। কাজেই যাঁরা কোচিং ও গাইড বইয়ের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা নতুন শিক্ষাক্রমকে ভালো চোখে দেখবেন না, সেটি আমরা বুঝি।
মজার ব্যাপার হলো, জরিপে মাত্র অর্ধেক শিক্ষক বলেছেন, তাঁদের হালকা–পাতলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল; যদিও তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসকেরা বলেছেন, সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে!
জরিপে অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, শিক্ষকদের কাজের ও পড়ানোর পদ্ধতিতে কি পরিবর্তন আনা উচিত। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অভিভাবক (প্রাথমিকে ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ) মত দিয়েছেন যে পড়ানোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। একই প্রশ্ন সরাসরি শিক্ষকদেরও করা হয়েছিল যে এই মুহূর্তে বাচ্চাদের পড়াশোনায় মূল সমস্যা কোথায়। সবচেয়ে বড় যে দুটি সমস্যার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনোযোগ ও দায়িত্ববোধের অভাব।
প্রশিক্ষণের মতো আরও একটি বিষয়ে আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনের মতামতের অসংলগ্নতা খেয়াল করেছি। জরিপে প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ শিক্ষক বলেছেন, শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামো নেই। অন্যদিকে অর্ধেকের বেশি তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসক দাবি করেছেন, সেই অবকাঠামো আছে। তথ্যের এই অমিল খুবই রহস্যময়।
আগের শিক্ষাক্রমের একমাত্র যে ব্যাপারটিতে আমি কিছুটা ভালো দেখতে পেয়েছি, সেটি হলো পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম (খেলাধুলা, নাচগান ইত্যাদি)। প্রাথমিক পর্যায়ে ৯১ দশমিক ২ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, তাঁরা পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট। মাধ্যমিক পর্যায়ে সন্তুষ্ট অভিভাবকের পরিমাণ ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ।
আপনি যদি পুরোনো পদ্ধতিতে পাঠদানের গুণগত মানের অভাব, শিক্ষাক্রমের আনন্দহীনতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষা প্রশাসনের যোগাযোগহীনতা, গাইড ও কোচিংয়ের খরচ—এসবের বেড়াজাল থেকে বের হতে না চান, তাহলে আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য হলো এসব সংশোধন করা।
সম্প্রতি শিক্ষার গুণগত মান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাচ্চারা বিদ্যালয়ে থাকলে দীর্ঘমেয়াদি জিডিপি ০ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে বাড়ে। এর অর্থ হলো বাচ্চারা যখন ১০ বছর স্কুলে থেকে এসএসসি পাস করে, সামগ্রিকভাবে সেই ১০ বছরে জিডিপি বাড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
সেই প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, যখন দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়, একটি ৩০ বছর মেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম জিডিপি বাড়ায় ৫ শতাংশ হারে। একই পরিমাণ সংস্কার কার্যক্রম আরও কম সময়ে চালানো হলে জিডিপিও তাড়াতাড়ি বাড়বে।
তুলনা করার জন্য বলি, ৮ বছরে বানানো পদ্মা সেতু জিডিপি বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের যে তোড়জোড় ছিল, সেটিকে যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে নিই, তাহলে এর চেয়ে বেশি জিডিপিতে অবদান রাখা শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নে কতটুকু তোড়জোড় করা প্রয়োজন?
পদ্মা সেতু যেমন টাকা বাচানোর জন্য এক মাইল কম বানালে হতো না, নতুন শিক্ষাক্রমও তেমনি শিক্ষার্থীদের যেসব যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করার কথা, তার চেয়ে ১ শতাংশ কম যোগ্যতা অর্জন করলেও চলবে না। অথবা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে শিক্ষকদের যে জীবনমান নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তার চেয়ে একটু কম হলেও চলবে না। আমাদের যে লক্ষ্য, সেটিতে পৌঁছাতে হবে। পদ্মা সেতুর চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব ও আন্তরিকতা নিয়ে সেটি করতে হবে।
সম্প্রতি পত্রিকার পাতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্মানিত অভিভাবকদের উৎকণ্ঠার কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে। এটি না হলেই বরং আমি অবাক হতাম। নতুন কিছু চালু হলে সেটি নিয়ে মানুষের মনে দ্বিধা, প্রশ্ন, সন্দেহ আর কৌতূহল থাকবেই। তার সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে। একজন অভিভাবক যখন তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান, তিনি শিক্ষা প্রশাসক ও নীতিনির্ধারকদের ওপর একধরনের বিশ্বাস স্থাপন করেন। সেই বিশ্বাস রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
আমাদের কোভিডের স্মৃতি এখনো তরতাজা। এর টিকা যখন চালু হলো, তখন সেটি নিয়ে দেশে–বিদেশে মানুষের সংকোচ ও সন্দেহের কথা সবারই মনে থাকার কথা। বাংলাদেশে যখন প্রথম সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি চালু করা হয়, রাতারাতি এটি সফল হয়নি। কাজেই যেকোনো দেশব্যাপী উদ্যোগে অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
তাঁরা ভাবছেন, পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, কিংবা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কী পদ্ধতিতে হবে অথবা বাসায় ঠিক কীভাবে বাচ্চাদের সাহায্য করতে হবে—কারণ তাঁরা তো এই পদ্ধতিতে পড়ে আসেননি। এখানে আমাদের কী করণীয়?
প্রথমত, নিয়মিত জরিপের মাধ্যমে অভিভাবকের উৎকণ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস পরিমাপ করতে হবে। সেই জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তৃণমূল পর্যায়ে তাঁদের আস্থা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট—সব মাধ্যমে আমাদের নিজ উদ্যোগে সঠিক ও স্বচ্ছ তথ্য পৌঁছে দিতে হবে।
যে অভিভাবক তাঁর স্থানীয় ধর্মগুরুকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন, তাঁর আস্থা অর্জনের জন্য আমাদের সেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক অবকাঠামো ব্যবহার করতে হবে। আর যে অভিভাবক সারা দিন টিকটকে কাটান, তাঁর জন্য আমাদের টিকটকে ভিডিও নিয়ে হাজির হতে হবে। এ ধরনের আস্থা এক দিনে অর্জিত হয় না। কাজেই আমাদের শিক্ষাক্রমসংক্রান্ত প্রচারণায় সেই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মানসিকতা থাকতে হবে।
এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রকাশিত গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদন ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আর কোনো জরিপ আমার চোখে পড়েনি। যদি আসলেই আর কোনো জরিপ না হয়ে থাকে, তাহলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ, তথ্য না থাকলে আমরা জানতে পারব না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের উৎকণ্ঠা কমছে, না বাড়ছে। আমাদের এটিও মাপতে হবে যে সরকারের জনসংযোগমূলক কার্যক্রমের মধ্যে কোনটি বেশি কাজে দিচ্ছে, আর কোনটি দিচ্ছে না।
আরেকটি কথা সবাইকে বিনয়ের সঙ্গে মনে করিয়ে দিব। আমরা যাঁরা এই নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের সব সময় মনে রাখতে হবে, ভিন্নমতাবলম্বীরা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাঁরা বিনা পয়সায় আমাদের হয়ে একটি কাজ করে দিচ্ছেন। তাঁরা যখনই বাস্তবায়নে কোনো ফাঁকফোকর দেখতে পাচ্ছেন, সেটি জোর গলায় জানিয়ে দিচ্ছেন। যাঁরা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করছেন, অথবা তাঁদের কেন যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, এ জন্য অভিমান করে বসে আছেন, তাঁদের কথা আমি এখানে বলছি না।
যেসব সমালোচক নিজের বিবেকের কাছে সৎ, তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও সহনশীলতা রাখতে হবে। আমরা কিন্তু নতুন পাঠ্যবইগুলোতে এসব চর্চা করার কথা বাচ্চাদের বলেছি।
একটি জাতীয় নীতি নিয়ে কখনোই দেশের সব মানুষ একমত হবে না। এটি গণতন্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য। দেশের সব মানুষকে আমরা একমত করার চেষ্টা করব না, বেশির ভাগ মানুষ একমত হলেই চলবে। তবে যিনি সৎভাবে আমাদের সঙ্গে শিখনপদ্ধতির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন, তাঁরও যেন আমাদের সততা ও আন্তরিকতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ না থাকে।
পৃথিবীর যেকোনো সরকারই সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই কাজ করা আরও কঠিন। আমি লিখে দিতে পারি, এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এই বাস্তবতা বোঝেন।
কাজেই সরকার যখন একটি নতুন উদ্যোগ নেয়, এতে প্রাথমিক ত্রুটিবিচ্যুতি যদি থাকে, সবাই বোঝেন যে এতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। কিন্তু মানুষ কষ্ট পান, যখন দেখেন কোথাও অবহেলা করা হচ্ছে, অথবা তাঁদের কথা কেউ শুনছেন না কিংবা চুরিচামারি করে তাঁদের করের টাকা শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু এই কষ্ট (একমুখী শিক্ষা, সৃজনশীল শিক্ষা, আগের দশকের প্রশ্নপত্র ফাঁস অস্বীকার করা, বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্পের দুর্নীতি, নিম্নমানের শিক্ষা উপকরণ ক্রয়—আরও কত কিছু!) ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পেয়েছে।
আমি আশা করব, আমরা যাঁরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কাজ করছি, তাঁরা সবাই এই ইতিহাস মনে রেখে, শ্রদ্ধেয় অভিভাবকদের উৎকণ্ঠার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে তাঁদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। নতুন শিক্ষাক্রমে তাঁদের সন্তান যে দক্ষতা, জ্ঞান ও মানসিকতা নিয়ে প্রবেশ করবে, বের হওয়ার সময় যেন তা বহুগুণে বিকশিত হয়, এই প্রতিজ্ঞা যেন আমাদের প্রতিটি নিশ্বাসে থাকে।
ওমর শেহাব নিউইয়র্কের আইবিএম থমাস জে. ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টারে একজন তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটারবিজ্ঞানী। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের অনুদানপ্রাপ্ত গবেষক এবং বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত।