পুতিনের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিলে বিপদে পড়বে আফ্রিকা

রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মানাঙ্গগাওয়া (বায়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেন্ট পিটার্সবার্গ, ২৭ জুলাই
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ক্রমাগত একঘরে হয়ে পড়ায় রাশিয়া এখন আফ্রিকা মহাদেশে তাদের পুরোনো ও অনুগত মিত্রদের একখানে জড়ো করেছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামে সেই দৃশ্যই দেখা গেল।

এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য’। এই প্রতিপাদ্য অবশ্যই পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া যে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী আচরণ করছে, পুরোপুরি তার বিপরীত। এ কারণেই আফ্রিকার নেতাদের দুটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এক. তাঁরা যেন অসাবধানতাবশত ইউক্রেন আগ্রাসনের ঘটনাটির অনুমোদন না দেন। দুই. কোনো ধরনের সমস্যাজনক বাণিজ্য চুক্তি না করেন।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে প্রথম যখন আফ্রিকা মহাদেশের ৪৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী শহর সোচিতে প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামের সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন, সে সময় প্রতিবেশী দেশের ওপর পুরো মাত্রায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করেনি রাশিয়া।

২০০৮ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে জর্জিয়ার ওসেটিয়া ও আবখাজিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে বেআইনিভাবে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। এরপর রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য পূর্ব ইউরোপে দোনেৎস্ক ও লুহানেস্কে গোপনে নিয়মিত বাহিনীর সেনা ও ভাড়াটে সেনা নিয়োগ দেয়।

বিশ্বাসযোগ্য বৈশ্বিক শক্তি ও অংশীদার হওয়ার মতো কোনো কাজই রাশিয়া করেনি। আফ্রিকার নেতারা সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবছেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তাঁরা এমন একটি আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেটা পাওয়ার যোগ্য তিনি নন।

সোচিতে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সম্মেলনে আফ্রিকার নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পুতিন আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে দেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার পুরোনো সম্পর্কের বিষয়েও জোর দিয়েছিলেন পুতিন।

পুতিন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর সামনে বসা ছদ্মগণতন্ত্রী ও স্বৈরশাসকেরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের নেতার কাছ থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে ভিন্ন ব্যাখ্যা শুনতে পছন্দ করবেন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব সংকুচিত হয়ে যায়। চীনসহ অন্য শক্তিগুলো সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

প্রকৃতপক্ষে চীন এখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আফ্রিকা মহাদেশে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। চীনের অর্থায়নে সেতু, রেল, বন্দর, স্টেডিয়ামের মতো প্রকল্পে আফ্রিকা মহাদেশ ভরে উঠছে।

পক্ষান্তরে, ২০১৯ সালে পুতিন আফ্রিকার জন্য সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব সমঝোতা স্মারকের বেশির ভাগের আইনগত বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র কারখানা রসোবোরননেক্সপোর্টের সঙ্গে সম্পাদিত অস্ত্রচুক্তি। এ ছাড়া আফ্রিকার ৩০টি দেশের সঙ্গে সম্পাদিত ‘সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা চুক্তি’। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইউয়ারি মুসেভিনি ও জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়ার মতো স্বৈরশাসকদের কাছে এই চুক্তির বিশাল মূল্য রয়েছে।

মুসেভিনি এ বছরের ২৫ মার্চ বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট’ এবং ‘তাদের উঁচু মানের অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়েও আমরা সন্তুষ্ট’। এই সন্তোষ প্রকাশের আগে তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়নের আদেশ দেন। তাতে করে অনেক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়, অনেকে আহত হন। জুলাই মাসে উগান্ডার কিছু নাগরিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মুসেভেনি ও তাঁর ছেলে মুহোজি কিনেরুগাবার (উগান্ডার সেনাবাহিনীর জেনারেল) বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।

জিম্বাবুয়ে অনেক বেশি দামে রাশিয়া থেকে ৩২টি হেলিকপ্টার কিনেছে। জিম্বাবুয়ের জনগণ যখন অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আর্থসামাজিক দুর্বিপাকের সঙ্গে লড়াই করছে, তখনই এমারসন মানাঙ্গগাওয়ার সরকার উচ্চ মূল্যে হেলিকপ্টার কিনছে।

এসব চুক্তি সমস্যাজনক। এগুলো আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার একমুখী সম্পর্কের দৃষ্টান্ত। অস্ত্র কেনার প্রস্তাব থাকলেও এমন কোনো বিনিয়োগের প্রস্তাব নেই, যাতে করে মহাদেশটির জনগণের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি হয় কিংবা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
আফ্রিকায় আসা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ রাশিয়ার। চীন কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় আফ্রিকায় রাশিয়ার বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষেই বামনাকৃতির। এর পরিমাণ আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরো বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ এবং চীনের তুলনায় ৬ শতাংশের বেশি নয়।

রাশিয়ায় রপ্তানির তুলনায় ৫ গুণ বেশি আমদানি করে আফ্রিকা। এর ফলে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল যে চীনের সঙ্গে তারা বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়াবে। কিন্তু সেটা অর্জন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

চার বছরে আরও অনেক দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়ার অর্থনীতি ২ দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ রাশিয়ার ব্যাংক, তেল শোধনাগার ও সামরিক রপ্তানির ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

রাশিয়ার জ্বালানি ও সামরিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও অবকাঠামো খাত লক্ষ্যবস্তু করেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ সম্পদশালী ব্যক্তিদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আফ্রিকা মহাদেশকে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে মরিয়া।

এটা সত্য যে অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকা মহাদেশের বড় বন্ধু ছিল। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও রাশিয়া একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল, যেখানে জাতিসংঘ সনদের রীতি–নীতিসহ আন্তর্জাতিক আইন মেনে সহযোগিতা শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছিল। এর ঠিক ১৬ মাস পর সেই সনদকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। এ ঘটনায় আফ্রিকায় অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়।

আফ্রিকার জন্য প্রগতিশীল, আইন মান্যকারী ও নির্ভরশীল অংশীদার দরকার। রাশিয়ার মতো বন্ধু দরকার নেই।

  • টাফি মাকা আল-জাজিরার কলাম লেখক এবং সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
    আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত