জিম্মি মুক্তি ও সাময়িক যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন একটি পর্বে উন্নীত হতে যাচ্ছে। চার দিনের এই বিরতিতে কয়েক ডজন জিম্মি মুক্তি পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিরতি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে একটি স্থিতিশীল ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগও বটে। আমরা একটা সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছি। সামনে বিকল্প এখন দুটি। হয় পৌনঃপুনিক দ্বন্দ্ব বা স্থায়ী সমাধান।
৭ অক্টোবর হামাসের রক্তক্ষয়ী আক্রমণ অনেকের জোরালো বিশ্বাসে সজোরে আঘাত করেছে। এই হামলা ফিলিস্তিন ইস্যুকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিরোধ সহজেই নিরসন সম্ভব এই ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের দাবিকে অগ্রাহ্য করেও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইসরায়েলের একীভূত হওয়া সম্ভব এই বিশ্বাসকে অসার প্রমাণ করেছে। ইসরায়েলি সমাজই এখন বুঝতে পারছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনা কোনো কাজে আসেনি। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই।
একই সঙ্গে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে আগ্রহী কয়েকটি দেশ স্থায়ী সমাধানের পরিবর্তে ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। এর পেছনে কিছু কারণও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। স্থিতিশীলতা ও স্বল্পমূল্যে জ্বালানি সুবিধা পেতে দেশ দুটি ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এদিকে আরব বিশ্বেও নেতৃত্ব নানা রকম অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাদের কাছে ফিলিস্তিন অঞ্চল শান্ত থাকাই যথেষ্ট। হামাসও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে খুশির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছে। তারা কূটনৈতিক এমন কোনো আলোচনায় যেতে চায় না, যাতে করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বৈধতা পায় কিংবা মধ্যমপন্থী রাজনীতিকেরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ, এতে তাদের শক্তি-সামর্থ্য কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
নেতানিয়াহুও কোনো টেকসই সমাধান চান না। কারণ, সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর জোট সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে, সরকার টিকিয়ে রাখাও তাঁর জন্য কঠিন হয়ে উঠবে। তিনি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চরমপন্থী ও বসতি স্থাপনের পক্ষে থাকা লোকজনের সমর্থনের ওপর নির্ভর করছেন। এই অংশটি ফিলিস্তিন ইস্যুতে একচুলও ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা হামাসকে সম্পদ মনে করে। কারণ, হামাস থাকলে শান্তিপ্রক্রিয়ার কথা উঠবে না।
চলমান সংঘাত মোকাবিলায় জোড়াতালির ব্যবস্থাপনা চলতে দেওয়ার নীতি অব্যাহত রাখলে কেউই অর্থসহায়তা দিতে আগ্রহী হবে না। কারণ, তাদের মনে এই শঙ্কা থাকবে যে কয়েক বছর পর আবারও এখানে যুদ্ধ হবে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যোগ্য নেতৃত্বের অভাব থাকার অর্থ হলো শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব বাইডেন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বাইডেনকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুই পক্ষই আদতে চায় মোটামুটি তীব্রতার দ্বন্দ্ব সংঘাত ও এর সমাধানে ভঙ্গুর ব্যবস্থা জারি রাখতে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আইডিএফ দীর্ঘ সময় গাজায় অবস্থান করার সুযোগ পাবে এবং হামাসের বিরুদ্ধেও তাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। এই সংঘাত গাজা উপত্যকায় সীমাবদ্ধ থাকবে। ক্রমেই সাধারণ মানুষ এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠবে। এ নিয়ে খবরের কাগজগুলোয় আর হইচই করবে না এবং বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে। এ অবস্থা চালু থাকবে যত দিন না গাজা, পশ্চিম তীর ও লেবাননে আরও বৃহৎ কোনো অভ্যুত্থান ঘটছে।
ইসরায়েলি সরকার এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যদি কোনো অর্থবহ পরিবর্তনে আগ্রহী না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিরোধের স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করতে হবে। উদ্দেশ্য বলতে বোঝাতে চাইছি, দুই দেশভিত্তিক সমাধান, আরব শান্তি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো এবং কত দিনের মধ্যে এই উদ্দেশ্য পূরণ হবে, তা পরিষ্কার করা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই কাজ শুরু করা যায়। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা, তা নিরসনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আরব বিশ্বের কোনো প্রতিনিধি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন। যদি এই বিকল্প না এগোয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এবং আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বড় রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে জো বাইডেন নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাঁর এ উদ্যোগ হতে পারে একটি বিস্তারিত কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। এতে করে এমন একটা ধারণা তৈরি হবে যে এই উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। গাজা এবং পশ্চিম তীরের হিসাব-নিকাশ এতে বদলে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ইসরায়েল যেভাবে ভূমি দখল করে চলেছে তার রাশ টেনে ধরবে। পাশাপাশি হামাসের বিপক্ষে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেও শক্তিশালী করে তুলবে। উপরন্তু, বাইডেনের নির্বাচনী ভবিষ্যৎও এতে উজ্জ্বল হতে পারে। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে তিনি যে জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন, তা ফেরত পেতে এই উদ্যোগ তাঁকে সাহায্য করবে।
উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা—এ নিয়ে যখন আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি নিতে পারে। সেটা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ফিলিস্তিনিদের একটি অন্তর্বর্তীকালীন যৌথ সরকার গঠন। আরব ও পশ্চিমাদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী গাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে আইডিএফকে সরিয়ে দিতে পারে। ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলোও গাজার অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে, যাকে বাইডেন বলছেন পুনরুজ্জীবিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। চলমান সংঘাত মোকাবিলায় জোড়াতালির ব্যবস্থাপনা চলতে দেওয়ার নীতি অব্যাহত রাখলে কেউই অর্থসহায়তা দিতে আগ্রহী হবে না। কারণ, তাদের মনে এই শঙ্কা থাকবে যে কয়েক বছর পর আবারও এখানে যুদ্ধ হবে।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যোগ্য নেতৃত্বের অভাব থাকার অর্থ হলো শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব বাইডেন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বাইডেনকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত এই নিবন্ধটি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত।
রোয়ি কিরবিক মিটভিম দ্য ইসরায়েলি ইনস্টিটিউট ফর রিজিওনাল ফরেন পলিসির পরিচালক।