মিয়ানমারে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির স্থিতিশীলতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপ একজোট হয়ে হামলা চালানোর পর বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি, গ্রাম ও সীমান্ত এলাকায় অস্থিতিশীলতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
তাতমাদো নামে পরিচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার অধ্যুষিত মধ্য ও উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন পর্যন্ত নিজেদের হাতে রাখতে পারলেও সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগই সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। দিনকে দিন সেখানকার আরও এলাকা জান্তা সরকারের হাতছাড়া হচ্ছে।
মিয়ানমারের এই অস্থিরতা আচমকা কোনো ঘটনা নয়। এখানকার বাস্তবতার সঙ্গে ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক আছে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করার পর দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধ দেখেছে। সীমিত পরিসরের গণতন্ত্রের নিরীক্ষা চলাকালে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ‘ইএও’) মধ্যে ছোটখাটো সংঘাত বাধত।
১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানে আরও বেশি সংখ্যক ইএওর উত্থান হয় এবং সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায়।
২০১৫ ও ২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে জান্তা এবং জান্তাবিরোধীদের মধ্যে মিলমিশের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু ২০২১ সালে তাতমাদো জান্তা সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেশটিকে আবার অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত করে। ২০২৩ সালের শরতে জান্তাবিরোধী শক্তিগুলো এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে।
বর্তমানে ইওএ ও বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির (বিসিপি) পুনর্গঠিত সশস্ত্র সংগঠন এমএনডিএএ ছাড়াও অভ্যুত্থানের কারণে ক্ষমতা হারানো এমপি ও রাজনীতিকদের গঠন করা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) মদদপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফস) সম্মিলিত শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে।
জান্তা সরকার এর আগে সব ধরনের সরকারবিরোধী আন্দোলন বর্ডার গার্ড ফোর্সেস (বিজিএফ) ও অন্যান্য সরকারপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপের সহায়তায় সফলভাবে দমন করে এসেছে। ফলে এসব বাহিনীর ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের সমাজের বিশাল অংশ এখন সরকারের বিরুদ্ধে এমনভাবে লড়াই করছে, যা জান্তা সরকারের ‘বিভাজন করো ও শাসন চালিয়ে যাও’ নীতিকে অনেক কম কার্যকর করে তুলেছে।
মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে বলেছেন, দেশটি ‘কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে’। তাঁর এই ঘোষণা সামরিক কর্মকর্তাদের রাজধানী নেপিডো (এটি একটি পরিকল্পিত শহর, যা কড়া নিরাপত্তার কারণে কার্যত একটি দুর্গ হিসেবে কাজ করে) থেকে পিছু হটতে প্ররোচিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের জন্মক্ষণ থেকেই দেশটির বিষয়ে চীনের ভূমিকার ঠিক ঠিকানা নেই। মিয়ানমারের কমিউনিস্ট পার্টি বা বিসিপি এবং অন্যান্য চীনপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপকে চীন সমর্থন দিয়ে এলেও ১৯৯০–এর দশকে পশ্চিমারা মিয়ানমারকে একঘরে করার পর জান্তা সরকার চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। মিয়ানমারকে স্থিতিশীল রাখতে এবং দক্ষিণ চীনের সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে বেইজিং মিয়ানমারকে সহায়তা দিতে থাকে।
এ ছাড়া চীন মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর (সিএমইসি) বানাচ্ছে। এই প্রকল্পের কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে পেতে চীন মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীন একদিকে জান্তা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রেখেছে, গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছে, আবার আরেক দিকে জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর চীনের এসব প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হয় এবং চীনের পরিচালিত বিভিন্ন অবকাঠামোতে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো হামলা চালায়। জান্তা সরকার এসব হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় জান্তার সঙ্গে বেইজিংয়ের উত্তেজনা শুরু হয়। এটি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দেবে বলে ধারণা করা যায়।
● জন পি রুহেল ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী একজন অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক। তিনি স্ট্র্যাটেজিক পলিসির প্রদায়ক সম্পাদক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত