সিরিয়ায় আসাদের পতনের অন্তিম দৃশ্যপটটা যেমন অনিবার্য ছিল, আবার সেটা শিক্ষামূলকও।
সরকারের বিরুদ্ধে সিরিয়ান বিদ্রোহীদের ১১ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের পর মাত্র ১১ দিনে সরকারের পতন হয়।
আসাদ সরকারের পতনই একমাত্র ঘটনা নয়। এটা তাৎপর্যপূর্ণ তার কারণ হলো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের একটা নেটওয়ার্ক সেখানে গড়ে উঠেছিল, নিজ নিজ দেশের স্বার্থের জায়গা থেকে তারা সেখানে নোঙর গেড়েছিল। শেষে তারা নিজেদের পতনকেই দেখতে পেয়েছে।
নিঃসন্দেহে পরাজিত পক্ষের কিছু কিছু খেলোয়াড় সিরিয়ার নতুন শাসকদের এই কষ্টার্জিত জয়কে খাটো করার চেষ্টা করবেই। তারা দামেস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নানাভাবে দুর্বল করার ফন্দি খুঁজবে।
এক দশক আগের আরব বসন্তের সময় থেকে আসাদ সরকার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ছিল।
যারা এই বিষাক্ত পরিবেশে তাদের রাজনৈতিক সম্পদ বিনিয়োগ করেছিল, তারা সিরিয়ার প্রতিরোধহীন সমাজ, দুর্বল ও বিভক্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধে স্বল্পকালীন বিজয়েই সন্তুষ্টি খুঁজেছিল।
২০১৫ সাল থেকে সিরিয়ার বিরোধীরা আবার সংগঠিত হতে শুরু করে। উত্তর সিরিয়ায় একটা বিশৃঙ্খলার ধ্বংসস্তূপ থেকে তখন ভঙ্গুর ধরনের একটা স্থিতিশীলতার জন্ম হয়েছিল। সেটাই দিনে দিনে একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
রাশিয়া ও ইরানের দিক থেকে বারবার লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের আস্তানা প্রক্রিয়ার ফলে যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছিল, তাতে করে বিরোধীরা তাদের পুনরায় সংগঠিত করার সময় ও পরিসর পায়। তুরস্ক থেকে প্রশাসনিক জ্ঞান পাওয়ার পর বিরোধীরা সেখানে প্রাথমিক একটা শাসনকাঠামো তৈরি করে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইরান আস্তানা চুক্তি এবং অন্য চুক্তিগুলোকে ভুলভাবে হিসাব করেছিল। তারা উত্তেজনা প্রশমন ও রাজনৈতিক সমাধানের উপায় হিসেবে এ চুক্তিগুলোকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এই ভুল হিসাবে শুধু আসাদের শক্তি ও সম্পদ ক্ষয় হয়নি, বিরোধীরা তাদের শক্তি ও সক্ষমতা বাড়ানোরও সুযোগ পেয়েছে।
আসাদের বাহিনীকে যেসব বিদেশি শক্তি শক্তি জুগিয়েছে, তাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ছিল। তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে আসাদের পতনকে ডেকে এনেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং লেবাননে বোমা হামলা, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পিকেকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভজকট ও নিজ দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের একের পর এক ভুল পদক্ষেপে আসাদের নিপীড়নযন্ত্রের ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।
২০২৪ সালের মধ্যে সিরিয়ার বিরোধীরা ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোকে পুঁজি করে দামেস্ক অভিমুখে বড় একটি অভিযান শুরু করে। কয়েক দশকের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ সাধারণ সিরীয়রা বিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এটি আসাদ সরকারের অসাড়তা ও অপ্রাসঙ্গিকতাকে প্রকাশ করে দেয়।
আসাদ শাসনের পতন শুধু সেখানকার বিদেশি খেলোয়াড়দের ধ্বংস করেনি, সিরিয়া এবং ওই অঞ্চলের সংখ্যালঘুর শাসনের ভিত্তিটাতেও আঘাত করেছে।
উদাহরণ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র আসাদের সংখ্যালঘু শাসনের মডেলকে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি–অধ্যুষিত এলাকায় শাসনের মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে) যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অধুনালুপ্ত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হুমকি মোকাবিলা করা জন্য যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কুর্দিদের জন্য একটি অসমর্থনীয় শাসনকাঠামো অনুমোদন করেছে।
এই প্রকল্প সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশজুড়ে। এটি আসাদের শাসনের মতোই ভঙ্গুর একটা শাসনব্যবস্থা। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি থেকে সরে আসবে কি না, সেটা অনিশ্চিত। কিন্তু এর কাঠামো থেকে লাখ লাখ আরব, কুর্দি ও তুর্কিদের বাদ দেওয়ায় এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যদি যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে সেনা সরিয়ে নেয়, সেই সমাধানটাই সবচেয়ে কম সহিংস হবে। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে অপ্রত্যাশিত কিছু পরিবর্তনের ওপর। বিশেষ করে পিকেকের আচরণের ওপর।
এর বিকল্প হিসেবে পিকেকের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র যদি সমর্থন অব্যাহত রাখে, তাহলে সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে।
যা–ই হোক, এই সংঘাত আগের দশকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি অজনপ্রিয় প্রশাসনকে টিকিয়ে রাখতে গেলে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে তা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়বে।
তথাকথিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের অস্তিত্ব বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলবে।
এদিকে সিরিয়ার গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা দেখে ইসরায়েল আতঙ্কিত বোধ করছে। ফিলিস্তিন কিংবা তার চারপাশে গণতান্ত্রিক ঢেউয়ের উত্থান হলে সেটা ইসরায়েলের বর্ণবাদী ও জাতিতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।
মধ্যপ্রাচ্য যদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দিয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য এবং পশ্চিমা সমর্থন ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই ভীতি থেকেই তারা আসাদের পতনের পর সিরিয়াজুড়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
তুরস্কের জন্য এক দশকের অপরিমেয় ব্যয়ের পরও তুরস্কে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গত এক দশকে আসাদের অধীনে থাকা অসংখ্য সিরিয়ানকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, ব্যাংকসেবা, বাণিজ্য ও অন্যান্য সেবা দিয়েছে। তুরস্ক-সিরিয়া সম্পর্কের গভীরতা আঞ্চলিক কোনো সম্পর্ক দিয়েই সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
একটা বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে কেবল এসব প্রচেষ্টা দিয়ে সিরিয়া পুনর্গঠন করা যাবে না। কিন্তু সিরিয়া পুনর্গঠনের ভিত্তি গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব সমর্থন খুবই গুরুত্ব।
তুরস্ক মনে করে, পিকেকে–নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ভেঙে দেওয়া সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সেটাকে টিকিয়ে রাখার মতো প্রয়োজনীয় জনসংখ্যাগত বৈচিত্র্য ও নিরাপত্তাশর্ত সেখানে নেই।
সিরিয়ায় একটা স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
তাহা ওজান তুরস্কের লেখক ও শিক্ষাবিদ
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত