নামজাদা ভারতীয়–মার্কিন সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া তাঁর এক কলামে তুরস্কের নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কেন সাম্প্রতিক নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত টিকে গেলেন, এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, এই নির্বাচন অবাধ ছিল, কিন্তু নিরপেক্ষ ছিল না। কারণ, শুরু থেকেই নির্বাচনী মাঠটি শুধু অসমান নয়, ভীষণ রকম একপেশে ছিল।
তা সত্ত্বেও বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারওলু যে তাঁকে এমন এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে ফেলে দেন, সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। মাঠটি যদি সমতল হতো, দুই পক্ষ সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে লড়াইতে নামতে পারত, তাহলে এরদোয়ান জিততেন কি না, তা বলা কঠিন।
ফরিদ লিখছেন, তুরস্কের রাজনৈতিক ক্ষেত্র এমনভাবে সাজানো যে তা ভীষণ রকম এরদোয়ানের অনুকূলে। রাষ্ট্রের তোশাখানা থেকে এরদোয়ানের সমর্থক ও দেশের তথ্যব্যবস্থার প্রতিনিধিদের জন্য উদারহস্তে অর্থ বিলি করা হয়। এমনিতেই দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এরদোয়ানের সমর্থক বড় বড় ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যারা এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সেই কোম্পানির মালিক সরকারি এক সমর্থকের কাছে বাধ্য হয়ে বেচে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন টেলিভিশন, যা কিনা সে দেশে খবরের প্রধান উৎস, তা অহোরাত্র সরকারের গুণগানে এতটা ব্যস্ত ছিল যে গত এপ্রিল মাসে, অর্থাৎ নির্বাচনের আগের মাসে তারা এরদোয়ানের সমর্থনে ৩২ ঘণ্টা ব্যয় করে। অন্যদিকে বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারওলুর পক্ষে ব্যয় হয় মাত্র ৩২ মিনিট।
নির্যাতনের ভয়ে সে দেশে সাংবাদিকদের মুখ খোলা কঠিন। সরকারবিরোধিতার অভিযোগে সে দেশে সর্বাধিকসংখ্যক সাংবাদিক জেলে রয়েছেন। রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘অপমান’ করা হয়েছে—এ অভিযোগে ৩০ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে।
এখন মোটামুটি পরিষ্কার, ২০১৬ সালের গণ–অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর এরদোয়ান দেশটিকে দ্রুত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসেন। অভ্যুত্থানের সমর্থক—এই সন্দেহে প্রায় সোয়া লাখ সরকারি কর্মচারীকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, অনেককে জেলে পাঠানো হয়। বিরোধী রাজনীতিকদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি বিচার বিভাগের কর্মীরাও ঢালাও ছাঁটাই থেকে রেহাই পাননি। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় আড়াই হাজার বিচারক চাকরিচ্যুত হন। তাঁদের জায়গায় রাতারাতি নিজ দলের সমর্থকদের নিয়ে আসেন এরদোয়ান।
আমাদের আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ইউরোপীয় উদ্বেগ ও হস্তক্ষেপের একটি সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে সুষম ও অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বেড়েছে। মানি বা না মানি, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত নয়—বিদেশিদের মধ্যে তেমন একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে গত নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম ঘটেছে, সে কথা আমাদের পত্রপত্রিকাতেই এসেছে।
সরকার তো বটেই, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, এমনকি সংবাদমাধ্যমেও এরপর আর লোক রইল না, যঁারা এরদোয়ান বা তাঁর অনুসৃত নীতির বিরোধিতা করে। ঠিক কীভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার গঠন করতে হয়, বলতে পারেন এ ছিল তঁার সেরা ‘নীলনকশা’।
এরদোয়ানের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ ছিল প্রধান বিরোধী নেতা একরেম ইমামোলুর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ। ২০১৯ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ভোট কারচুপির অভিযোগ সে নির্বাচন বাতিল হলে তিনি দ্বিতীয়বার আরও বেশি ভোটে জয়লাভ করেন। তখন এরদোয়ান তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদের ‘অপমান’ করার অভিযোগ আনলেন। তিনি জাতীয় নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়লেন। ব্যস, রাস্তা পরিষ্কার।
বাংলাদেশ কী শিখতে পারে
তুরস্ক ও বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির মানচিত্রে যে মিল রয়েছে, তা বোধ হয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ফ্রিডম হাউসের বৈশ্বিক সূচক অনুসারে, তুরস্ক ও বাংলাদেশ উভয় দেশই ‘অংশত মুক্ত’। রাজনৈতিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এই দুই সূচকে তুরস্কের নম্বর ৩২ (১৬ + ১৬)।
অন্যদিকে এই দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট নম্বর ৪০ (১৫ + ২৫)। অন্য কথায়, গণতান্ত্রিক বহুপাক্ষিকতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে তুরস্ক ও বাংলাদেশের অবস্থান কার্যত অভিন্ন। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মতো তুরস্কের ব্যাপারে কোনো নতুন ভিসা নীতি আরোপ করেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত নয়টি দেশ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। তুরস্কের ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তুরস্কের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, যখন খেলার মাঠটি আগাগোড়াই অসম, সেখানে সুষম নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। নানা রকম ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ রয়েই যাবে। যে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে, তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আইন প্রয়োগকারী ও বিচারব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের তথ্যব্যবস্থা, সেখানেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ পর্বতসমান।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ—এমন সংবাদপত্র হাতে গোনা। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম, যার মালিকানা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধনবান ব্যবসায়ীদের হাতে, যাদের উদ্দেশ্য সরকারকে তুষ্ট রেখে ফায়দা আদায় করা, তারা যে ভিন্ন সুরে কথা বলবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। এরপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি বিষফোড়া রয়েছে, যা ডেমোক্লিসের তরবারির মতো সাংবাদিকদের মাথার ওপর ঝুলছে। তাহলে বাংলাদেশে কি নির্বাচনী নিরপেক্ষতা অর্জন একদমই অসম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর আংশিক হলেও ওই তুরস্ক থেকেই পেতে পারি।
আগেই বলেছি, তুরস্কের নির্বাচন হয়তো নিরপেক্ষ হয়নি, কিন্তু তা মুক্ত ছিল। সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছেন কোনো বাধা ছাড়াই, তাঁদের ভোট যথাযথভাবে গোনাও হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে নির্বাচনের সময় ও পরে দেশজুড়ে অসংখ্য নির্বাচনী পর্যবেক্ষক থাকায়। এ ব্যাপারে প্রধান কৃতিত্ব তুরস্কের সবচেয়ে পুরোনো নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ভোট অ্যান্ড বিয়োন্ড’–এর, তারা সারা দেশে হাজার হাজার পর্যবেক্ষক পাঠায়। শুধু ভোটের সময় নয়, ভোট গণনার সময়ও সেসব পর্যবেক্ষক উপস্থিত থেকেছেন।
ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা বলেছে, নির্বাচনী ব্যবস্থায় পূর্ণ স্বচ্ছতা ছিল, সে কথা বলা যাবে না, কিন্তু মানুষ ভোট দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। আর সে ভোট যথাযথভাবে গোনাও হয়েছে। এ কাজে নিরপেক্ষ, বেসরকারি পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে যদি বেসরকারি নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা জোরদার করা যায়, তাহলে ভোটবিহীন নির্বাচনের প্রহসন ঠেকানো সম্ভব, এ কথা অযৌক্তিক নয়।
তুরস্কের ক্ষেত্রে এরদোয়ানকে জিততে সবচেয়ে বেশি যা সাহায্য করেছে, তা হলো তথ্যব্যবস্থার ওপর পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ। দেশের মানুষ বারবার সে গল্পই শুনেছে, যা তাদের শোনানো হয়েছে। এই অবস্থা বদলাতে বিরোধী কোয়ালিশন যা করেছে, তা হলো সামাজিক তথ্যমাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার। সরকারি টেলিভিশনে জায়গা না পেলে কী হবে, কেমাল কিলিচদারওলু নিজ গৃহের খাবার টেবিলে বসে ছোট ছোট ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। প্রথম দফা ভোটে তিনি যে কার্যত এরদোয়ানকে ধরে ফেলেছিলেন, তার এক বড় কারণ সামাজিক তথ্যমাধ্যমের এই দক্ষ ব্যবহার।
অদৃশ্য ‘ভয়’
আমাদের আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ইউরোপীয় উদ্বেগ ও হস্তক্ষেপের একটি সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে সুষম ও অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বেড়েছে। মানি বা না মানি, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত নয়—বিদেশিদের মধ্যে তেমন একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে গত নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম ঘটেছে, সে কথা আমাদের পত্রপত্রিকাতেই এসেছে।
সম্প্রতি মার্কিন সরকার সে রকম অনিয়ম ঠেকাতে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এর ফলে সরকার ও বিরোধী পক্ষ—উভয়েই নড়েচড়ে বসেছে। উভয়েই বলেছে, ব্যাপারটা মোটেই নেতিবাচক নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তা সবার কাছেই কাম্য। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যাঁরা ক্ষমতার চেয়ারে বসেন, তাঁদের মার্কিন ভিসা চাই। ছেলেমেয়ে আমেরিকায় থাকে, তঁাদের সঙ্গে দেখা করতে মাঝেমধ্যে যাওয়া চাই। ফলে অনুমান করি, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা দেখে-বুঝে কোনো রকম অনিয়ম করবেন না।
বিশ্বের নড়বড়ে গণতন্ত্রের দেশগুলোতে যে সামরিক অভ্যুত্থান কমে এসেছে, এর অন্যতম কারণ নিষেধাজ্ঞার ভয় বা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকি। তার মানে এ ধরনের উদ্যোগ কাজ করে।
আমেরিকান ভিসা নীতিও সে রকম একটি চাপ, যেখানে ভিসা না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ধরনের ভয় কাজে দিতে পারে।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক