২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সিটি করপোরেশন গাছ কাটে কেন?

গাছ রক্ষার আন্দোলনে নগরবাসী। রাজধানী ঢাকা।
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার সাতমসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের গাছগুলো কাটার মর্মবিদারী দৃশ্য যে রাজধানীবাসীকে দেখতে হলো, আজকের দিনে এটা অকল্পনীয়। নগর কর্তৃপক্ষের প্রকল্প নেওয়া উচিত গাছ লাগানোর, গাছ রক্ষা করার, রাজধানীকে সবুজ করে তোলার। সেখানে সিটি করপোরেশন এমন প্রকল্প কীভাবে গ্রহণ করতে পারল, যাতে এতগুলো গাছ কাটা পড়ে?

এই রকম একটা চিন্তা কার মাথা থেকে এল? এই প্রকল্পের নকশাকারটা কে? কোন ইঞ্জিনিয়ার, কোন পরিকল্পনাবিদ? আজকের দিনে যেকোনো প্রকল্প প্রণয়নের আগে এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের মত নিতে হয়। পরিকল্পনা প্রণয়নে জনগণের অভিজ্ঞতা, পরামর্শ অনেক কাজে লাগে। সাতমসজিদ রোডে সড়ক বিভাজক ভেঙে, গাছ কেটে আবার সড়ক বিভাজক বানানোর এই দুর্বুদ্ধি এল কার মাথা থেকে? পত্রিকান্তরে খবর পড়লাম, ‘ডিএসসিসির বিভিন্ন সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনে ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডেও সড়ক বিভাজকের উন্নয়নকাজ হচ্ছে।’ সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য গাছ কাটা? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে সিটি করপোরেশনের বৃক্ষ হত্যা কর্মসূচির পেছনের যুক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করছি।

জানা যাচ্ছে, ১. বছিলা থেকে নতুন একটা বাসরুট হচ্ছে সাতমসজিদ রোড ধরে। সে কারণে এই রাস্তার গুরুত্ব বেড়েছে। এই রাস্তায় বাস চলবে। ২. সড়ক বিভাজকগুলো অসমান ছিল। এগুলোকে সমান করা হচ্ছে। ৩. আগের গাছগুলো ছিল অপরিকল্পিত। এগুলোর কারণে রাস্তার অনেকটাই অব্যবহৃত থেকে যেত। ফলে যানজট হতো। ৪. সড়ক বিভাজকের মধ্যে এপাড়-ওপাড় যাওয়ার ‘কাটা জায়গা’ ছিল বেশি। এ কারণে যানজট বেশি হতো।

এই যুক্তিগুলো যে খোঁড়া, তা বুঝতে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। ১. এই রুটে চিরকাল বাস চলাচল করছে। বছিলার বাস এমন কোনো মহাযান নয়, যে তার জন্য সড়ক বিভাজক বদলাতে হবে। ২. সড়ক বিভাজক অসমান থাকবে কেন? এটা কি সিটি করপোরেশনই ডিজাইন করেনি। আগেরটা যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে আগের ইঞ্জিনিয়ারদের কি শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে? সড়ক বিভাজক দুই ফুট এদিক-ওদিক করলেই যান চলাচল রেশমের মতো মোলায়েম হবে, এই গ্যারান্টি কি আপনারা দিতে পারবেন? ৩. আগের গাছগুলো অপরিকল্পিত লাগানো হলো কেন? আমগাছ, জামগাছের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। আমগাছ, জামগাছ যদি রাস্তার দিকে হেলেই পড়ে, তা হলে ডাল কাটলেই তো হতো। মোট কয়টা গাছ রাস্তার ওপর চলে আসে, চিহ্নিত করে বিশেষ রকমের ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এখানে তো গণবৃক্ষ হত্যা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ৪. বিভাজকে ঘন ঘন বিরতি ছিল। তা দিয়ে যানবাহন এপাশ-ওপাশ করতে গিয়ে যানজট বাড়াত। বিভাজকের ‘কাটা’ বন্ধ করতে পুরো বিভাজক তুলে ফেলে আবার লাগাতে হয়, এটা তো মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো ঘটনা হলো!

আরও পড়ুন

ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে এই গণবৃক্ষ হত্যা কর্মসূচি একটাই বার্তা দিচ্ছে, তা হলো, আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচি একচক্ষু দানবের মতো, তা প্রণয়ন করার আগে পরিবেশের কথা, মানুষের কথা, অংশীজনের মতামতের ব্যাপারে কোনোরকমের তোয়াক্কা করা হয় না। এবং এই পরিকল্পকেরা একটা প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কেই জানেন না, তা হলো, গাছ কাটলে সৌন্দর্য বাড়ে না। বোঝাই যাচ্ছে, তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য, একটা বাজেট প্রণয়ন করা আর ঠিকাদারদের হাতে বাজেটটা তুলে দেওয়া।

ঢাকা শহর তপ্ত চুল্লি হয়ে আছে। এখানে হিট স্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। গাছ লাগানো এই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানে একটা বড় পদক্ষেপ হতে পারে। সারা পৃথিবীতে আন্দোলন চলছে, গাছ লাগান। গাছ বাঁচান। আমরা আমাদের শহরে সৌন্দর্যের নামে গাছ কাটছি। সুমনের গান আছে, ‘আমি চাই গাছ কাটা হলে প্রতিবাদ হবে বিধানসভায়।’ ধানমন্ডির বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা, স্থানীয় মানুষেরা বিক্ষোভ করছেন, আন্দোলন করছেন। আমাদের জাতীয় সংসদে এ নিয়ে কি কেউ কোনো প্রশ্ন তুলেছেন? কোনো আলোচনা হয়েছে?

মানুষ এখনো পুরোটা ঘুমিয়ে পড়েনি, রূপকথার মৃত্যুপুরীর মতো সবকিছু এখনো পাথরে পরিণত হয়নি। গাছ বাঁচাতে তরুণেরা সারা রাত জেগে গাছ পাহারা দিয়েছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছেন। কোনো আন্দোলনই ব্যর্থ হয় না। এই আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। কর্তৃপক্ষের মূঢ় বিবেককে তা আঘাত করবে, জাগিয়ে তুলবে।

গাছ কাটা কেবল ধানমন্ডিবাসীর ক্ষতি করবে না, এটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে এই পৃথিবীকেই। আমরা জানি, পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে। বৃক্ষ, চিরসখা মানবের, পারে এই মরণযাত্রা থেকে পৃথিবীটাকে বাঁচাতে। ১৯৭৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে গাছ কাটা বন্ধ করতে স্থানীয় নারী-পুরুষেরা এক অভিনব আন্দোলন করেন। চিপকো আন্দোলন। চিপকো মানে গাছ জড়িয়ে ধরা। খেলার সামগ্রী নির্মাণের জন্য বনের গাছ কাটার অনুমতি নিয়ে এসেছিল ঠিকাদারেরা। নারীরা গাছ জড়িয়ে ধরে রাখেন সারা রাত। খবর পেয়ে আশপাশের গ্রামবাসী ছুটে এসে গাছ জড়িয়ে ধরে রাখেন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী আইন করে দেন, এই বনে সবুজ গাছ ১৫ বছর কাটা যাবে না।

এ রকম আরও অনেক আন্দোলনই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে গাছ রক্ষার দাবিতে। বাংলাদেশেও হয়েছে। কিছুদিন আগে কলাবাগানের মাঠরক্ষার দাবিতে স্থানীয় মানুষদের আন্দোলন সাফল্যের মুখে দেখেছে। সাতমসজিদ রোডের গাছ রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়েছে একটু দেরিতে। এরই মধ্যে পাঁচ শরও বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়ে গেছে।

তবু এত নিরাশার মধ্যে আশা কিন্তু এখানেই। মানুষের প্রতিবাদ। মানুষ এখনো পুরোটা ঘুমিয়ে পড়েনি, রূপকথার মৃত্যুপুরীর মতো সবকিছু এখনো পাথরে পরিণত হয়নি। গাছ বাঁচাতে তরুণেরা সারা রাত জেগে গাছ পাহারা দিয়েছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছেন। কোনো আন্দোলনই ব্যর্থ হয় না। এই আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। কর্তৃপক্ষের মূঢ় বিবেককে তা আঘাত করবে, জাগিয়ে তুলবে। ভবিষ্যতে যেকোনো উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের আগে পরিবেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, স্থানীয় মানুষের যেন মতামত নেওয়া হয়, এসব ব্যাপার বাধ্যতামূলক হিসেবে গৃহীত হবে।

সদ্যপ্রয়াত চিন্তাবিদ ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিই: ‘প্রতিবাদ যদি ন্যায়সংগত হয়, যে-কোনও হিসেবেই তা জমা পড়বে লাভের কোটায়। প্রথমত, আত্মশক্তি নাগরিকের বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, সকলের মঙ্গলের জন্য সমবেত উদ্যোগে মিলিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাবেই প্রতিবাদের মাধ্যমে আত্মশক্তি পরিণত হয় গণশক্তিতে, আর তারই ফলে গণতন্ত্রের প্রসার ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ বলেই মানুষ তার মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। সব জীবের মধ্যে সে যে তার মানবিক বিবেকে, শুভবুদ্ধিতে, সংকল্পে সম্পূর্ণ আর এক প্রকার সত্তা, এই চেতনার উদ্ভাসে নিজের সঙ্গে সে নিজে মুখোমুখি হয়। এ সাক্ষাৎকার কি কখনওই ক্ষতিকর হতে পারে?’ [শাসিতের সম্মতি ছাড়া গণতন্ত্র চলে না]

রণজিৎ গুহ বলছেন, ‘মানুষ যে মানুষ, মানুষ যে অন্য পশুর চেয়ে আলাদা, তার যে বিবেক আছে, শুভ বুদ্ধি আছে, সংকল্প আছে, প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই মানুষ তা অর্জন করে, প্রকাশ করে। কাজেই প্রতিবাদ আমাদের জারি রাখতেই হবে। যদি আমরা নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চাই।’

প্রতিবাদ আপাতদৃষ্টে ব্যর্থ মনে হতে পারে। নোয়াম চমস্কিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরা তো এখন হতাশায় ভোগেন, এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

চমস্কি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি এটাই বলব যে তাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত। দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরুন, এই আন্দোলন সফলতার জন্য কত দীর্ঘ সময়ের সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল। তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়ে আপনি যদি প্রতিবারই আপনার প্রচেষ্টার হাল ছেড়ে দেন, তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ সংগ্রাম।’

তিনি বলেছেন, ‘নাছোড়বান্দা হওয়া ছাড়া এযাবৎ কোনো আন্দোলনই সফলতার আলোর মুখ দেখেনি।’ (নোয়াম চমস্কির সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চাভিলাষ। অনুবাদ রফিকুল রনি। প্রকাশক নাগরী)।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক