শুক্রবার রাজধানীর সকালটা শুরু হয়েছিল বৃষ্টি দিয়ে। ভরা শ্রাবণেও টানা বৃষ্টিশূন্যতার পর কালো মেঘ করে নেমেছে বৃষ্টি। রাজধানীর নয়াপল্টনে সেই বৃষ্টির সকালেই আসতে শুরু করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। দুই দিনের নাটকীয়তার পর মহাসমাবেশের স্থান ঠিক হয়েছে। মাত্র চার দিন আগেই ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল মিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সফল তারুণ্যের সমাবেশ করেছে। ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এভাবে ঘুরে দাঁড়ানো বিস্ময়ই বলা চলে।
শুক্রবারের মহাসমাবেশ ঘিরে দারুণভাবে উজ্জীবিত বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢল নামে তাঁদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টন অভিমুখে। কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে দারুণভাবে সক্রিয় বিএনপির মিডিয়া সেল। একটু পরপর তারা জানিয়ে দিচ্ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের আগমনবার্তা। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জেলা, উপজেলা থেকে নেতা-কর্মীরা আসছিলেন। ব্যানারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক জিয়ার সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতার ছবি।
হাততালি আর স্লোগানে মুখর মিছিলের সংখ্যা বাড়ছিল। বাড়ছিল নেতা-কর্মীদের সংখ্যা। এর মধ্যে কমলাপুর স্টেশন থেকে লাইভ। রাজশাহী থেকে ট্রেনে করে নেতা-কর্মীরা এসেছেন। প্ল্যাটফর্ম পা দিয়েই তাঁরা স্লোগান দিতে শুরু করলেন। মিছিল করে প্ল্যাটফর্ম ছাড়লেন। একটু পর আরেকটি ট্রেনে নেতা-কর্মী আসার লাইভ। লোকাল ট্রেনের বগি ও ছাদভর্তি নেতা-কর্মী। স্লোগান, হাততালিতে মুখর প্ল্যাটফর্ম। বিরোধী দলের সমাবেশে ট্রেন ভর্তি করে নেতা-কর্মীরা এসেছেন, এ দৃশ্য বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুর্লভ।
এটা অবশ্য মুদ্রার এক পিঠ। বিপরীত পিঠের গল্পটাও আছে। দুদিন আগে থেকেই সংবাদমাধ্যমের খবরে আসছিল, ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশ কীভাবে মুঠোফোনের ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, কললিস্ট, মেসেজ বক্স ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এখানে নাগরিকের প্রাইভেসি নামের মানবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক শ নেতা-কর্মীকে। নেতা-কর্মীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ারও খবর এসেছে গণমাধ্যমে।
এরপরও দুই দলের সমাবেশে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও উদ্দীপনা নিয়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকেরা অংশ নিয়েছিল, তাতে একটা দিনের জন্য হলেও রাজনীতি জনমানুষের কাছে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ১২ ঘণ্টা যেতে যেতে না যেতেই রাজনীতি থেকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হারিয়ে গেল। সেই পুরোনো সহিংসতা ফিরে এল। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ কতটা সক্ষম হয়ে উঠেছে, তার প্রদর্শনী দেখা গেল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভিত শক্ত না করে রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে তাতে যে জনগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, সেই নিখাদ সত্যিটা আবারও সামনে চলে এল।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের সঙ্গে কারওয়ান বাজার থেকে রওনা দিলাম বেলা দুইটায়। রাস্তায় যানবাহন খুব কম। যা-ও দু-একটা বাস আসছে, তাতেও ঠাসাঠাসি ভিড়। যাত্রীদের সঙ্গে আমরাও অপেক্ষায়। একটু পাশে সাদা ক্যাপ পরিহিত স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েক কর্মীর জটলা। তাঁরা যাবেন নয়াপল্টন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বায়তুল মোকাররমে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের শান্তি সমাবেশে। অপেক্ষা করছিলেন পিকআপ ভ্যানের জন্য। বিএনপির সমাবেশে কত লোক হয়েছে, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। একজনকে বলতে শুনলাম, ‘বিএনপির তো পিছিয়ে আসার রাস্তা নাই। তারা তো মরিয়া।’
অনেক বলেকয়ে এক সিএনজি অটোরিকশাচালককে রাজি করানো গেল। যাবে প্রেসক্লাব পর্যন্ত, যে পর্যন্ত যাওয়া যায় আরকি। বাংলামোটর পেরিয়ে সার্ক ফোয়ারা হয়ে কাকরাইলের রাস্তা। দুধারে বিক্ষিপ্তভাবে বাস আর পিকআপ ভ্যানের সারি। নীল, সাদা, হলুদ, লাল, কমলা রঙের ক্যাপ পড়ে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে চলেছেন। যত এগোচ্ছি, ততই রাস্তার পাশে পার্ক করে বাসের সংখ্যা বাড়ছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খাবারের প্যাকেট। মিছিলের ভিড়ে সিএনজির গতি থমকে যেতে থাকে। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ নিয়ে জিজ্ঞেস করায়, সিএনজিচালক বললেন, ‘আমাদের তো খেটে খেতে হয়। এক দিন গাড়ি বন্ধ রাখলে আয়-ইনকাম বন্ধ। জিনিসপত্রের দাম তো কমে না।...জোরে বৃষ্টি নামুক, তাইলে দেখা যাবে, কজন লোক থাকে মিটিংয়ে।’
জাতীয় ঈদগাহের সামনে সিএনজি থেকে নেমে পড়তে হলো। মিছিলকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে থাকি। সচিবালয়ের কাছে পৌঁছাতেই বৃষ্টি শুরু হলো। সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছাতার নিচে কোনো রকমে মাথা বাঁচিয়ে বাঁচার প্রচেষ্টা। বৃষ্টি খণ্ড খণ্ড মিছিলের স্রোত ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারেনি। অধিকাংশ মিছিলে কিশোর থেকে তরুণ বয়সীরা। মেয়েদের একটা মিছিলও এগিয়ে গেল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। বেশ উদ্দীপনা আর উৎসবের আবহ। এর মধ্যে কেউ কেউ ভুভুজেলাও বাজাচ্ছেন। একসময় টানা বৃষ্টি থেমে গেলে এগোতে শুরু করলাম। ততক্ষণে শান্তি সমাবেশ শুরু হয়ে গেছে। নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণে বিএনপিকে ঠেকানোর আওয়াজ তুলছেন। কিন্তু কর্মীরা যাঁর যাঁর নেতার ব্যানার, প্লাকার্ড হাতে। ফুটপাথে কিছুটা পরপর ওয়াসার পানির ট্যাংক আর শিকলে বাধা প্লাস্টিকের মগ। অনেকেই গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। মাইকে ভাষণ চলছে। পুলিশেরা জটলা করে দাঁড়িয়ে। শিথিল ভঙ্গিতে গল্প করছেন।
পল্টন মোড় ‘বর্ডার লাইনে’ সতর্ক দাঁড়িয়ে সশস্ত্র পুলিশ। মুখ করে আছেন বিএনপির সমাবেশের দিকে। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপির লোকজন একসঙ্গে হচ্ছেন। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন না। পল্টন থেকে যতই সামনে যাওয়া যায়, ততই জনস্রোত বাড়তে থাকে। একটু আগে যে বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাতে নেতা-কর্মীরা ঠায় ভিজেছেন। গায়ের পোশাক ভিজে গায়ের সঙ্গেই লেপ্টে আছে তাঁদের।
রাস্তার দুই পাশে মাঠা, সন্দেশ, শিঙাড়া, শসা, কলা, পানির বোতল, বাদাম—কত যে খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। মাইকে শোনা যাচ্ছে, একের পর এক নেতার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নেতা-কর্মীরা নিজেরা জটলা করে কথা বলছেন। স্লোগান তুলছেন। কেউ জাতীয় পতাকা নাড়ছেন। কেউ আবার দলীয় পতাকা ওড়াচ্ছেন। কেউ ভিডিও করছেন। কেউ সেলফি তুলছেন। অনেকের হাতে তাঁদের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড। বিএনপির সমাবেশে আসা নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৩০ বছর থেকে মধ্যবয়সীদের সংখ্যা বেশি। রাস্তায় কতটা যুদ্ধ করে তাঁরা সমাবেশে পৌঁছেছেন, কেউ কেউ তা জানালেন। আবার অনেকে বাধা না পেয়ে আসতে পারার কথাও বললেন। ফিরে আসছি যখন, তখন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটা বাজে।
ঘর থেকে পথে নামার সময়টা বেশির ভাগের জন্যই ততক্ষণে ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। অনেকের হয়তো দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আবার ঘরে ফেরার তাড়া। ক্লান্তি, শ্রান্তি তো আছেই। তাঁরা ঠিক জানেন না, সামনের দিনগুলোতে কী হবে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক। তাঁরা যেন তাঁদের নিজেদের ভোটটা দিতে পারেন। চোখেমুখে উদ্দীপনা আছে, আছে প্রত্যয়ও।
কাকরাইল থেকে রমনার দিকের রাস্তা পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে বিএনপির মহাসমাবেশের একপ্রান্ত। পাশ দিয়েই শান্তি সমাবেশের দিকে তখনো যাচ্ছে আওয়ামী লীগের মিছিল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না। কেউ কারও দিকে তেড়েও যাচ্ছে না।
শুক্রবার সারা দিনই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলেছে ঢাকার প্রকৃতিতে। বিএনপির কর্মসূচির পাল্টায় আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিয়েছে। এরপরও দুই দলের সমাবেশে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও উদ্দীপনা নিয়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকেরা অংশ নিয়েছিল, তাতে একটা দিনের জন্য হলেও রাজনীতি জনমানুষের কাছে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ১২ ঘণ্টা যেতে যেতে না যেতেই রাজনীতি থেকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হারিয়ে গেল। সেই পুরোনো সহিংসতা ফিরে এল। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ কতটা সক্ষম হয়ে উঠেছে, তার প্রদর্শনী দেখা গেল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভিত শক্ত না করে রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে তাতে যে জনগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, সেই নিখাদ সত্যিটা আবারও সামনে চলে এল।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী