কিছু কথা আছে, যার সঙ্গে বাস্তবের যে মিল নেই, তা বক্তাও জানে, শ্রোতাও জানে। বলার জন্য বলা। এগুলোকে বলে কথার কথা। ভোট নিয়ে এই কথার কথা বেশি শোনা যায়।
ধরুন, নির্বাচন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। ডজনখানেক টেলিভিশন চ্যানেলের বুম তাঁর সামনে। ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার হচ্ছে।
কর্মকর্তা নির্বিকারভাবে মেশিনের মতো বলে যাচ্ছেন, ‘ভোট হবে অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ।’
চোখ বন্ধ করে বলা যায়, লোকে এটিকে স্রেফ কথার কথা ঠাওরাবে। পাবলিক এ কথা শুনবে, কিন্তু বিশ্বাস করবে না।
কারণ, এই দেশে ভোটের সঙ্গে ‘অবাধ’, ‘নিরপেক্ষ’, ‘স্বচ্ছ’, ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দগুলো যায় না। আলংকারিক শব্দ হিসেবে এগুলো জোর করে ‘যাওয়ানো’ হয়।
নেতা যখন ভোটারের ভোট দেওয়ার অধিকারকে মহিমান্বিত করার কপট চেষ্টায় বিকট চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’, তখন লোকে বোঝে, নেতা আসলে বলতে চান, ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব’।
স্থানীয় নির্বাচনে যখন দলীয় প্রতীক ছিল না, যখন খেজুরগাছ বা কলাগাছ বা চেয়ার-টেবিল মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে লোকজন প্রার্থী হতেন, তখন ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ কথাটার হয়তো কিছুটা দাম ছিল; কিন্তু প্রায় এক দশক আগে ইউপি বা পৌরসভার নির্বাচনে নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা বা লাঙ্গলওয়ালারা সরাসরি মার্কা বিক্রির ডিলারশিপ পাওয়ার পর ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব’ কথাটা একেবারে পাকা কথা হয়ে গেছে।
৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট বদলেছে। মানুষের মধ্যে নতুন নতুন ভাবনা আসছে। সে কারণে হয়তো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মনে হচ্ছে, ভোট নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছে। তাই হয়তো তারা আমাদের ‘ভাবতে’ বলেছে।
গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার প্রথম আলোর শেষের পাতায় রীতিমতো চাররঙা বিজ্ঞাপন দিয়ে ইসি কাকে ভোট দেব, তা নিয়ে আমাদের, মানে ভোটারদের সিরিয়াসলি ভাবতে বলেছে।
ওই বিজ্ঞাপনে ইসি বলেছে:
‘নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দেবেন?
একটু ভাবুন’
ইসি জিজ্ঞাসা করেছে:
‘দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীকে ভোট দেবেন?’
ইসি নিজেই জবাব দিয়েছে—‘না’।
একইভাবে ইসি নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর ‘ফাঁস করে’ দিয়েছে:
‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারীকে ভোট দেবেন?—না
সন্ত্রাসী, মাস্তান ও চাঁদাবাজকে ভোট দেবেন?—না
ভূমিদস্যুকে ভোট দেবেন?—না
অন্যায়কারীকে ভোট দেবেন?—না’
ইসির সর্বশেষ প্রশ্ন:
‘সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবেন?’
এবারের উত্তর—‘হ্যাঁ’।
সবশেষে ইসি একটা ‘মোরাল অব দ্য স্টোরি’ টেনে মহল্লার ছেলেপেলের উদ্দেশে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিচক্ষণ মুরুব্বির ঝেড়ে দেওয়া পৃষ্ঠপোষকতাসুলভ নসিহতের ভাষায় বলেছে:
‘নিজ উদ্যোগে সময়মতো ভোটার হোন
নিজের পছন্দে ভোট দিন
সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত করুন।’
নির্বাচন কমিশন এই ‘অসময়ে’ পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোটারদের ‘নিজের পছন্দে’ ভোট দিয়ে ‘সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত’ করতে বলল কেন, তা পরিষ্কার নয়।
কবে জাতীয় নির্বাচন হবে; আগামী বছর হবে কি না; জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন ওড়াউড়ি করছে। এসব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব কারও কাছে নেই।
প্রথমে সেনাপ্রধান বললেন, ‘১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে’।
এরপর আইন উপদেষ্টা বললেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব।’
এরপর নৌপরিবহন উপদেষ্টা বললেন, ‘২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে।’
এরপর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হলো, নির্বাচনের বিষয়ে দিনক্ষণ ঠিক করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা বললেন, ‘আগামী বছরই আমরা একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার পাব।’
তার মানে নির্বাচন নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে।
তবে চুম্বক কথা বলে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়ে রেখেছেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ শেষে দেশ নির্বাচনী ট্রেনে চড়বে।
এ রকমের একটা অবস্থার মধ্যে ইসি আমাদের ‘একটু ভাবুন’ বলে ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
আমার মতো কোনো কোনো নাদান ভোটার সরল মনে আন্দাজ করতে পারেন, ইসি হয়তো শিগগিরই স্থানীয় নির্বাচন দিতে চায়।
এ ভোটের মাধ্যমে ‘হাত মকশো’ করে হয়তো তারা জাতীয় নির্বাচনে যেতে চায়।
আলোচ্য বিজ্ঞাপনে ইসি আমাদের ‘দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীকে’; ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারীকে’; ‘সন্ত্রাসী, মাস্তান, ও চাঁদাবাজকে’; ‘ভূমিদস্যুকে’ ও ‘অন্যায়কারীকে’ ভোট দিতে না করেছে।
ইসির কথার অর্থ দাঁড়ায়, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী, সন্ত্রাসী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু এবং অন্যায়কারী নিশ্চিতভাবে ভোটে দাঁড়াবেন। তা না হলে ইসি কেন আমাদের বলবে, এদের ভোট দেবেন না।
ইসি যেন বলছে, এই খারাপ লোকগুলোর সঙ্গে ‘সৎ ও যোগ্য’ প্রার্থীও দাঁড়াবেন এবং তাঁদের ভোট দেওয়াই ঠিক কাজ হবে।
কথা হলো দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী, সন্ত্রাসী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যুদের ভোটে দাঁড়াতে না দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যেত।
ভোটারদের আলাদা করে সতর্ক করতে হতো না। এখন ইসি যেহেতু এক রকমের নিশ্চিতভাবেই জানে, খারাপ লোকেরা দাঁড়াবেন, সেহেতু তাঁরা যাতে না দাঁড়াতে পারেন, তার উপায় জানার দায়িত্বও তাঁদের।
মাস্তান-চাঁদাবাজদের ভোটে দাঁড়ানোর পথ বন্ধ না করে যাত্রাপালার বিবেকের কায়দায় ‘তাঁদের ভোট দেবেন না’ বলে ভোটারদের পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে ‘চোরকে চুরি করতে আর গেরস্তকে সজাগ থাকতে’ বলার মধ্যে তফাত থাকে না।
২.
ইসি আমাদের ‘সৎ ও যোগ্য প্রার্থী’কে ভোট দিতে বলেছে। প্রশ্ন হলো, এই বাজারে এই ‘আশ্চর্য জিনিস’ আমরা কোথায় পাব?
একটা সময় ছিল, ইউপি বা পৌরসভা নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় লোকদের স্থানীয় ভোটাররা দাঁড় করাতে চাইতেন।
তাঁদের কেউ কেউ দাঁড়াতে চাইতেন না। অনেক সময় সত্যিকার অর্থে কাউকে কাউকে জনতার দাবির মুখে ভোটে দাঁড়াতে হতো। তাঁরা হাঁস, মুরগি, ছাতা, চেয়ার, টেবিল—এ ধরনের বারোয়ারি মার্কা নিয়ে ভোটে দাঁড়াতেন।
নির্বাচন অফিসে ‘টাকা জমা’ দেওয়ার পর এলাকায় মাইকে মাইকে ভরে যেত। ‘গরু মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে দেশের লোক’; ‘মায়ের কোলে শিশুর ডাক, মোরগ মার্কা জিতে যাক’; ‘নীল আকাশের পাখির ঝাঁক, ছাতা মার্কা জিতে যাক’—এসব স্লোগানে হাট-বাজার মুখর হতো।
কিন্তু ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধন আইনের মাধ্যমে হাসিনা সরকার দলীয় মার্কার অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করল। সেটি ২০১৬ সালে কার্যকর হলো।
এরপর থেকে কেউ জেতার ইচ্ছায় ভোটে দাঁড়াতে চাইলে আর ভোটারের বাড়ি বাড়ি ধরনা ধরতে চাইল না।
তাঁরা টুক করে ঢাকায় এসে এমপি সাহেবের কাছে কিংবা বড় দলের নেতাদের সঙ্গে ‘একান্তে’ দেখা করা শুরু করলেন। নমিনেশন কেনাবেচা শুরু হলো।
প্রথম দিকে নৌকা এবং ধানের শীষ মার্কা কেনাবেচা হতো। পরে নৌকা ছাড়া আর কিছু থাকল না। ‘নৌকা মার্কা যার, চেয়ারম্যানশিপ তার’ নীতি পোক্ত হয়ে গেল।
নৌকা মার্কা বাগিয়ে নেওয়ার পর প্রার্থীদের ভোটারের কাছে যাওয়ার দরকার হলো না। ভোটের আগেও না, পরে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, তত দিনে সবাই মেনে নিয়েছে ‘সবার ওপরে দল সত্য, তারও ওপরে দলনায়িকা’।
সেই আইন এখনো আছে।
এই আইন রেখে কোটি টাকা খরচা করে দলীয় মার্কা কেনা লোকের মধ্যে ‘সৎ ও যোগ্য’ লোক খোঁজার জন্য বাটি চালান দিলে বাটি হয়রান হয়ে ফিরে আসবে। সে লোক পাওয়া যাবে না।
কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এবং দলগুলো চালানো নেতাদের বাস্তব জ্ঞান ও বিষয়বুদ্ধি বরাবরই টনটনা। তাঁরা স্থানীয় প্রভাবশালী লোকের বাইরে মার্কা বিতরণ করবেন না।
আর এই জমানার রাজনীতির মাঠে একই সঙ্গে প্রভাবশালী ও সৎ লোক পাওয়া কঠিন। সেই কঠিন কাজকে সহজ করা আরও কঠিন; তবে অসম্ভব নয়।
এর জন্য সবার আগে সরকার ও ইসির সদিচ্ছা দরকার।
সরকার ও ইসিকে আগে ঠিক করতে হবে, কথার কথা বলে কোনো কথা তাদের ডিকশনারিতে থাকতে পারবে না। নির্বাচন ইস্যুতে তারা যেটি বলবে, সেটিই তারা ‘মিন’ করবে।
ইউপি, পৌরসভার মতো স্থানীয় নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে যোগ্য প্রার্থীমুখর করতে অবশ্যই এই ভোটকে নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা, লাঙ্গল মার্কার ‘সিন্ডিকেট’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তার জন্য বিদ্যমান স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করতে হবে।
অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের দাঁড়ানোটা যাতে কঠিন করে দেওয়া যায় এবং সৎ ও যোগ্য লোক যাতে সহজে দাঁড়াতে পারেন, সে জন্য ইসিকে প্রয়োজনে যোগ্যতার নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে হবে।
কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল; কোনটি উচিত, কোনটি অনুচিত—সেই পার্থক্যটি ভালো করে বোঝার জন্যও শিক্ষার আলো জরুরি। উচ্চশিক্ষিত হলেই সবাই দুর্নীতিমুক্ত মানুষ তথা ভালো মানুষ হতে পারে না—এই বাস্তবতা স্বীকার করেই বলা যায়, ভালো–মন্দের পার্থক্য বুঝতে সহায়তা করা শিক্ষার আলো যাঁর ওপর পড়েনি, জনসমাজের প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুদায়িত্ব তাঁর জন্য বাঞ্ছিত নয়।
এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দেওয়া দরকার। কারণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা এমন একটি প্রয়োজনীয় গুণ, যা জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকারের ভিত্তিকে মজবুত করে দেয়।
কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল; কোনটি উচিত, কোনটি অনুচিত—সেই পার্থক্যটি ভালো করে বোঝার জন্যও শিক্ষার আলো জরুরি। উচ্চশিক্ষিত হলেই সবাই দুর্নীতিমুক্ত মানুষ তথা ভালো মানুষ হতে পারে না—এই বাস্তবতা স্বীকার করেই বলা যায়, ভালো–মন্দের পার্থক্য বুঝতে সহায়তা করা শিক্ষার আলো যাঁর ওপর পড়েনি, জনসমাজের প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুদায়িত্ব তাঁর জন্য বাঞ্ছিত নয়।
এর বাইরে এমন কিছু গুণ থাকার শর্ত রাখা দরকার, যে গুণের মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতি একটি মানুষের সদিচ্ছাপূর্ণ মনোভাব ধরা পড়বে।
এ ক্ষেত্রে ভারতের হরিয়ানায় ২০১৫ সালে পাস হওয়া একটি আইনের কথা বলতে পারি।
সে আইন অনুযায়ী, সেখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে প্রার্থীকে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাস করতে হবে এবং প্রার্থীর বাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে শৌচাগার থাকতে হবে।
এখানে শৌচাগার থাকার বাধ্যবাধকতা রাখাকে অনেকের অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টির নিহিতার্থ গভীর।
কারণ সমাজের প্রতি, পরিবেশের প্রতি, পরিজনের প্রতি কোনো ব্যক্তির কী মনোভাব, বাড়িতে শৌচাগারের উপস্থিতিটিই তা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিতে পারে।
আর সেই মনোভাবই বলে দিতে পারে, তাঁর প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা আসলে আছে কি নেই।
আমাদের ভোটে সৎ প্রার্থী বের করে আনতে এ ধরনের পন্থা খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে।
ইসিকে মনে করিয়ে দিতে চাই, দেশের মানুষ ভালো লোককে ভোট দিতে চায়। তারা ইসির কাছে খারাপ লোককে ভোট না দেওয়ার পরামর্শের চেয়ে খারাপ লোকেরা যাতে ভোটে দাঁড়াতে না পারেন, সেই ব্যবস্থাটাই বেশি করে চায়।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]