ঈদ কেনাকাটার মৌসুমে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হলো রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সের চারটি বিপণিবিতানসহ মোট আটটি বিপণিবিতানের প্রায় পাঁচ হাজার দোকান। সেই সঙ্গে পুড়েছে ঈদ উপলক্ষে বিক্রির জন্য রাখা বিপুল পরিমাণ পোশাক, নগদ টাকা ও বাকি পাওনার কাগজ। এভাবে হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর স্বপ্ন পুড়ে নিঃশেষ হওয়ার পর জানা গেল, ২০১৯-এর এপ্রিলেই কাঠ ও টিনের তৈরি ঘিঞ্জি এ মার্কেট কমপ্লেক্সটিকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল।
এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কিংবা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দোকান মালিক সমিতির নেতাদের বাধার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ টিনের ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দোকান মালিক সমিতির নেতারা উচ্চ আদালত থেকে নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছিলেন।
অন্যদিকে দোকান মালিক সমিতির নেতাদের বক্তব্য হলো, নতুন মার্কেট নির্মাণকালে দোকানদারেরা কোথায় যাবেন এবং বর্তমান দোকানমালিকেরা সবাই নতুন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাবেন কি না, বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভাড়া নেওয়া দোকানগুলো একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে পরবর্তীকালে বাড়তি অর্থ ব্যয় না করে বুঝে পাবেন কি না, তাঁদের সঠিকভাবে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা হবে কি না—এসব বিষয়ে সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা থেকে তাঁরা আদালতে রিট করতে বাধ্য হয়েছেন।
একটা মার্কেট বা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে সেটাকে ঝুঁকিমুক্ত করা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মার্কেটের মালিক হিসেবে ডিএসসিসির উচিত ছিল মার্কেটটিকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া। পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের পেছনে ডিএসসিসির উদ্দেশ্য সৎ হলে এবং তারা স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দোকানমালিকদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আশ্বস্ত করলে, প্রয়োজনে লিখিত চুক্তি করে নিলে দোকানমালিকদের দিক থেকে মার্কেটটিকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য বাধা থাকার কথা নয়।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ এ মার্কেটের দোকানমালিকদের কাছ থেকে মাসে মাসে ভাড়া নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মার্কেট কমপ্লেক্সটি ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য দোকানমালিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, চুক্তিসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যেসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারত, সেগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। ফলে দোকানমালিকেরা অগ্নিঝুঁকির বিষয়টিকে তাঁদের উচ্ছেদ করার অজুহাত হিসেবে দেখেছেন। আজ যখন আগুনে পুড়ে হাজারো ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেলেন, তখন দায় নেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না!
রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ফায়ার ব্রিগেডের সদর দপ্তরের উল্টো দিকে অবস্থিত একটি মার্কেট কমপ্লেক্সের অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে যদি এ ধরনের অবহেলা দেখা যায়, তাহলে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য ভবনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-১৯ থেকে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ যে বছর বঙ্গবাজার মার্কেটকে অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই একই বছর তারা মোট ৫৪১টি শপিং মল/মার্কেট, ৯৪টি স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়, ১৭৩টি ব্যাংক, ১৭৩টি হাসপাতাল/ক্লিনিক, ৭০টি আবাসিক হোটেল ও ১৮টি মিডিয়া সেন্টারকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
প্রশ্ন হলো, এই যে ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করছে; পরবর্তীকালে এগুলোর ঝুঁকি নিরসন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কি কেউ আদৌ নিচ্ছে? নাকি বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সের মতোই নোটিশ দেওয়ার দায়সারা পদক্ষেপের মধ্যেই আটকে আছে এসব ভবন ঝুঁকি নিরসনের উদ্যোগ! আমি মনে করি, শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তার সংখ্যা প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, এ ভবনগুলোর তালিকা প্রকাশ করে এগুলোর ঝুঁকি নিরসনের জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তার নিয়মিত আপডেট প্রকাশ করা উচিত।
অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিরসনের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণই কি একমাত্র পদক্ষেপ? অগ্নিসতর্কসংকেত বা ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, ফায়ার এক্সিট, অগ্নিনির্বাপণসামগ্রী, পানির রিজার্ভার, ফায়ার হাইড্রেন্ট, রাইজার ইত্যাদি না থাকলে মার্কেট বা বহুতল ভবন কোনো কিছুরই অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। প্রশ্ন হলো, ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে বঙ্গবাজারের ঘিঞ্জি মার্কেট ভেঙে বহুতল ভবন না হয় নির্মাণ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ, কিন্তু অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছিল? উদাহরণস্বরূপ, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার প্রসঙ্গটিই তোলা যাক। অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত এ মার্কেট কমপ্লেক্স পুরোপুরি ভেঙে নতুন করে তৈরি করার আগপর্যন্ত কোনোভাবে আগুন লাগলে যেন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায়, সে জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার কিংবা ফায়ার হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের বিশেষ কল) কি স্থাপন করা যেত না?
বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী, স্বেচ্ছাসেবক ও মার্কেটের দোকানদারদের অনেকেই বলেছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই যদি পর্যাপ্ত পানি দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো আগুন এতটা ছড়াতে পারত না, ক্ষয়ক্ষতিও এত বেশি হতো না। কিন্তু আশপাশে কোনো জলাধার বা পানির উৎস না থাকায় ফায়ার সার্ভিসকে সময়মতো পর্যাপ্ত পানি সংগ্রহে বেগ পেতে হয়। ফলে সময়ের ব্যবধানে পুরো এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সঙ্গে আসা পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুর থেকে পানি নেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ পাইপে পানি নেওয়ার কারণে চাপ না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটে। পানিসংকটের কারণে এমনকি হাতিরঝিল থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে পানি নেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, রাজধানী ঢাকায় পানির উৎসের সংকটের কথাটি তো অজানা নয়। তাহলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা বঙ্গবাজারে পানির বিকল্প উৎস যেমন ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা করা হলো না কেন? শুধু বঙ্গবাজার নয়, রাজধানী ঢাকার সব স্থানেই অন্তত ৫০০ মিটার দূরত্বে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, একটি বাসযোগ্য শহরের ন্যূনতম ৩৫ শতাংশ এলাকায় জলাভূমি ও ফাঁকা জায়গা থাকা প্রয়োজন হলেও ঢাকায় আছে মাত্র ৯ শতাংশ, যার মধ্যে জলাভূমির পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ফাঁকা জায়গা ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। অথচ ১৯৯৯ সালেও জলাভূমির পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া সরকারের মৎস্য বিভাগের এক জরিপ অনুসারে, দখলদারি ও আবাসন চাহিদার কারণে গত প্রায় তিন দশকে ঢাকার ১ হাজার ৯০০টি সরকারি ও বেসরকারি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। ফলে ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড হলেই পানির সংকট দেখা দেয়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ভরাট ও দখলদারির শিকার হওয়া খাল, পুকুরসহ জলাধার পুনরুদ্ধার করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জরুরি হলো রাস্তায় রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা, যেন অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের পানি সংগ্রহে বেগ পেতে না হয়।
২০১৯ সালে বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ঢাকা ওয়াসাকে ঢাকা শহরজুড়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম স্থাপন করার কথা বলে। ২০২১ সালে মহাখালী সাততালা বস্তির অগ্নিকাণ্ডের পরও ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে, কিন্তু আজও রাজধানী ঢাকায় অগ্নিনির্বাপণে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য ফায়ার হাইড্রেন্টের মতো জরুরি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ সম্পন্ন হলো না।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সম্প্রতি বেশ কতগুলো বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সায়েন্সল্যাব, সীতাকুণ্ড ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনায় ভবন বা কারখানার মালিক থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী ও তদারকি সংস্থার অবহেলার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সমস্যা ও ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিতাস গ্যাসের লিকেজ বন্ধ করার ব্যবস্থা হচ্ছে না, পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য প্লাস্টিক ও রাসায়নিকের গুদাম সরানো হচ্ছে না, ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত কারখানা ও ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি তারই ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। বঙ্গবাজার ঘিরে বহুতল ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা ও তাতে ব্যবসায়ীদের সায় না থাকার সঙ্গে এ অগ্নিকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সে বিষয়ে যেমন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, সেই সঙ্গে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস, কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন তদারকি সংস্থার জবাবদিহি নিশ্চিত করে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর স্থায়ী অবসান হওয়া প্রয়োজন।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]