২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, পৃথিবী যখন করোনা মহামারি থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে ফেরার সংগ্রামে রত, তখন রাশিয়া তাদের ভাষায় ‘স্পেশাল অপারেশন’ বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় ‘আগ্রাসী যুদ্ধ’ শুরু করে ইউক্রেনে। রাশিয়া বলছে, লুহানস্ক ও দোনেস্কের রুশভাষীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব বলছে, ইউক্রেনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে—তারা ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে কি না, এটা তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ ছাড়া তাদের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা বজায় রাখার অধিকার রয়েছে; যদিও আপাতদৃষ্টে এ যুদ্ধকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ মনে হচ্ছে, তা কার্যত রাশিয়া বনাম পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক এ যুদ্ধকে পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে রুশ ও চৈনিক কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী ব্যবস্থার লড়াই হিসেবেও দেখছেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে এ রকম, রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। যুদ্ধের দামামা বাজছে ইউরোপে। কিন্তু তার ফল আক্ষরিক অর্থেই সুদূরপ্রসারী হচ্ছে। বাংলাদেশও এ যুদ্ধের প্রভাবের বাইরে নয়। বস্তুত, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোথাও সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুতই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যেমন ২০০৮ সালে বিশ্ব মন্দার শুরুটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণশিল্পে। তা দ্রুতই অন্যান্য শিল্পে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি বা উলুখাগড়া কোনোটিই নয়, তবু বাংলাদেশের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় খাদ্যসহ নানা পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে গেছে বাংলাদেশে। যুদ্ধের শুরুতেই কেউ কেউ এ আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মাঝামাঝিতে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে পৃথিবীর মানুষদের শাস্তি দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে।’ তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাঁর প্রশ্ন সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে দুর্বল করতে পারেনি। বাংলাদেশে জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হলেও রাশিয়া জ্বালানিসংকটের ফলে স্ফীতমূল্যে তেল-গ্যাস বিক্রি করে লাভবান হয়েছে। সুইফট-ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া রুশদের জন্য শাপেবর হয়েছে। রুশ মুদ্রা রুবল সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে, তবে যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ভুক্তভোগী হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র ভারত মানেনি। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে কম মূল্যে তেল কিনেছে। রুবলে মূল্য পরিশোধ করেছে। বিনিময় মূল্যের সংকটের কারণে বাংলাদেশ তেল কিনতে পারেনি। আবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রুশ জাহাজ ভারতীয় বন্দরে পণ্য খালাস করেছে। সেদিক বিবেচনা করে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পণ্যবোঝাই নিষিদ্ধ জাহাজ স্পার্টা-৩ (বা উরসা মেজর) ভারতের হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাস করতে চেয়েছিল। ভারত প্রথমে রাজিও হয়েছিল, কিন্তু মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যাপারটিতে বাদ সাধে। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বৈরথে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের বিপরীতে নিজের দলে পেতে আগ্রহী। এ জন্য তারা ভারতকে অনেকটা ছাড় দেবে। সংগত কারণেই যে ছাড় বাংলাদেশ পাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত মানতে বাংলাদেশ আইনত বাধ্য নয়। তবে জাতিসংঘ সনদের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মানতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের অধীন বাধ্য। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তা পরিষদ তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য সশস্ত্র শক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়—এমন কোনো পদক্ষেপ প্রয়োগ করা হবে কি না, তা নির্ধারণ করতে পারে এবং এই পরিষদ জাতিসংঘের সদস্যদের এ ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োগ করার আহ্বান জানাতে পারে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং রেল, সমুদ্র, বিমান, ডাক, টেলিগ্রাফিক, রেডিও এবং যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলোর সম্পূর্ণ বা আংশিক বাধা প্রদান ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো নিরাপত্তা পরিষদে এর পাঁচটি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের ভেটো-ব্যবস্থা থাকায় কোনো স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ অনুচ্ছেদের অধীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে না। কারণ, রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ও ভেটোর মতো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকায় কারও কারও জন্য সুবিধাজনক হলেও প্রকৃতপক্ষে এ ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল হচ্ছে না। তবে ভেটো-ব্যবস্থা থাকার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণে নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন পায়নি।
বাংলাদেশের সামনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জটি সব দেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি বাংলাদেশ ও তার মতো কিছু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশকে রাষ্ট্র হতে হলে অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা জরুরি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আইনি বয়ান (ডিসকোর্স) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার অনুগামী হয়ে চলে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপওনারস অ্যাসোসিয়েশনের (বোগসা) চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব জাহাজে চেপে যদি কোনো পণ্য বাংলাদেশে আসে, বাংলাদেশকেও নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত করা হবে।’ আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড় একটি অংশ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আজম জে চৌধুরী মনে করেন, ‘বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের রুশ জাহাজ নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমরা যেসব দেশের সঙ্গে ব্যবসা করি, সেসব দেশের তালিকার প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া নেই।’
ব্যাপারটি অতটা সরল নয়। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে এবং নানাভাবে সমর্থন জুগিয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হলো ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। এ নীতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি। এখন আমাদের সামনে প্রশ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমরা সম্পর্ক নষ্ট করতে পারি কি না? না, পারি না। কারণ, পররাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। আবার ওই একই জাতীয় স্বার্থের কারণে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও রুষ্ট করা যাবে না। গত দেড় দশকে পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা ভারসাম্য রক্ষা করে এসেছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রুশ জাহাজ উরসা মেজরকে ভিড়তে না দেওয়ায় গত মঙ্গলবার রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করেছে। সাম্প্রতিক কালে এ রকম তলবের নজির নেই। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আন্দ্রে রোদেনকো বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানের কাছে জাহাজ ভিড়তে না দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের সামনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জটি সব দেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি বাংলাদেশ ও তার মতো কিছু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটি সঠিক যে রাশিয়া বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের বড় বাজার নয়। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ রাশিয়ার ঋণ, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিবিদদের ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের জন্য রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কথা মাথায় রাখলে রাশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান নেওয়া সমীচীনও নয়। এমন পরিস্থিতে বাংলাদেশ উভয়সংকটে পড়েছে।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন