মৃত্যু বলেকয়ে আসে না। সেটি স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যু—যা–ই হোক। তবে এ দেশের মৃত্যু এতই সস্তা হয়ে গেছে বা করে ফেলা হয়েছে, মৃত্যু আসলে বলেকয়েই আসে। সে জন্য কেউ ঘর থেকে বের হলে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রশ্ন আসতে পারে, সেই নিশ্চয়তা কি আসলে কেউ দিতে পারে? এখানে ‘কেউ’ যখন রাষ্ট্র বা সরকার হয়, তখন তার কিছু দায়দায়িত্ব থাকে তার নাগরিকের প্রতি। তার খাতিরেই স্বাভাবিক মৃত্যুর ন্যূনতম নিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার কথা, যা আমরা একটি সভ্য রাষ্ট্র বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে দেখতে পাই। এ কথা অনস্বীকার্য, নানা সময়ে নানা সরকার দেশের উন্নয়নে ‘অভূতপূর্ব সাফল্য’ দেখাতে পারলেও কোনো সরকারই একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র আমাদের দিতে পারেনি।
এ দেশে প্রতিটা ক্ষেত্রে আইন আছে। যাঁরা আইন তৈরি করেন, আইন যাঁদের প্রয়োগ করার কথা আর আইন যাঁদের মানার কথা—সবাই একই পাল্লায় উঠে একসঙ্গে ঝুলছে বলা যায়। আর অন্য পাল্লায় একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু জমা হয়ে সেটির ওজনই ভারী হতে থাকে।
একটা সময় এ দেশ ছিল নদীমাতৃক দেশ। এখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর দেশ বললে কি ভুল হবে? হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন থেকে শুরু করে নানা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হিসাব করলে বছরে যত মানুষ এ দেশে মারা যায়, অনেক যুদ্ধেও হয়তো তত মানুষ মারা যায় না। অনেকে অনেক দেশের তুলনা টানবেন জানি। কিন্তু আমি আমার দেশের কথাই বলতে চাই। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন কত মানুষ মারা যায়, সেসব আমাদের এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
একটু ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ মৃত্যু না হলে পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে সেই খবর কেউ পড়ে না কিংবা অনলাইনের লিংক খুলে দেখে না। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মাথার ওপর একটি ইট বা ফুলের টব পড়ে মারা যাওয়াও এখানে কোনো ঘটনাই নয়। দুর্ঘটনায় রাজধানী শহরে কোনো বনেদি এলাকায় কারও মৃত্যু হলে বা বনেদি ঘরের কোনো সন্তান মারা গেলে নাহয় কিছু মানুষের মধ্যে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খানিক আলোচনা তৈরি হয়। বাকি মৃত্যুগুলোর ঘটনারও মৃত্যু ঘটে বা ঘটিয়ে ফেলা হয়।
চট্টগ্রাম শহরের বলা যায় একেবারে মাঝখানে এবং ব্যস্ততম এলাকা জামালখানে ভবনের কার্নিশ ধসে জলজ্যান্ত দুজন মানুষ মারা গেলেন। এ নিয়ে খবরও হলো সংবাদমাধ্যমে, কিন্তু বিষয়টি কারও মধ্যে ছাপ তৈরি করল না। ছাপ না বলে ইস্যুও বলতে পারেন। তার মানে বিষয়টি আসলে এমন দাঁড়াল, এমন মৃত্যু তো হতেই পারে বা এ তো নতুন কিছু নয়। ঘটনাটি জামালখানের শিকদার হোটেলের পাশেই।
চট্টগ্রামবাসীর রসনার আনজাম দেওয়ার অনেক পুরোনো ও প্রিয় একটি খাবারের হোটেল। তাঁর পাশেই একটি পুরোনো ভবন ভাঙা হচ্ছিল। কিন্তু ছিল না কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা। সেটি না থাকারই কথা। কারণ, সুরক্ষাব্যবস্থা যে রাখতে হয়, সেটি যে নিশ্চিত করতে হয়, সেটি না জানলে কারও কিছু যায়–আসে না বা কোনো সমস্যাও হয় না। ফলে ভবনের ছাদের কার্নিশের একটি অংশ ভেঙে ফুটপাতে পড়ে। মারা যান দুজন ব্যক্তি। সেই দুজন ব্যক্তি হচ্ছেন আবার ভবনটি ভাঙার দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তি ও তাঁর এক হেলপার। ফলে অনেকেই বলবেন, নিজেদের দোষেই তাঁদের মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে আমরা এসব মৃত্যুর দায় ব্যক্তির কাঁধে তুলে দিতে পারি। প্রায়ই এমন ঘটনার ক্ষেত্রে নানাভাবে সেটিই তো ঘটে, তাই নয় কি!
চট্টগ্রামের জামালখান এলাকাটি হচ্ছে শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য বহুল পরিচিত। এ এলাকায় ও এর আশপাশে অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার আর বেসরকারি ক্লিনিক ও চিকিৎসকের চেম্বার। সারা দিন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, রোগীর ব্যস্ততা ওই এলাকায়। শিকদার হোটেলের সামনে দিয়েই তাঁদের চলাচল। একবার ভাবুন তো, স্কুলফেরত কোনো শিক্ষার্থী দলের ওপর ছাদের কার্নিশটি যদি ভেঙে পড়ত, কী পরিস্থিতিটা হতো?
গত বুধবার বিকেল চারটার দিকে ঘটা এ ঘটনার জন্য কেউ দায়ী নয়। মানে এই দুই মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। যেটি আগেভাগেই আমরা কোনো নির্মাণ কর্মকাণ্ডের সামনে সাইনবোর্ডে লাগিয়ে থাকতে দেখি আরকি। যদিও শিকদার হোটেলের সামনে ফুটপাতে এমন কিছু ছিল না। এরপরও এ ঘটনার জন্য কেউ দায়ী নয়। এ কারণে হয়তো থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। যদিও এসব ক্ষেত্রে পুলিশ চাইলে ফৌজদারি মামলা করতে পারে, কিন্তু সেটি হয়নি।
একটা শহর কতটা অপরিকল্পিত ও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে, তা বুঝতে সিটি করপোরেশন, রাজউক বা চউকের মতো এসব কর্তৃপক্ষের অবহেলা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, অনিয়মের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায়। প্রতিটি ভবন তৈরিতে বা ভাঙতে বিভিন্ন পর্যায়ে কোনো না কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি থাকবেই। গোটা প্রক্রিয়াকে জটিল করে রাখা হয় সে জন্য। ফলে নাগরিকেরাও সেই দুর্নীতি বা অনিয়মের সুযোগ নিতে বাধ্য হন।
এখানে বাড়ির মালিকেরই প্রধান দায়িত্ব ছিল সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা, তিনি তা করেননি। যে মানুষদের হাতে কাজ তুলে দিয়েছেন, তাঁদের তিনি সুরক্ষাব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেননি। অথচ সেই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধেও কোনো মামলা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তা হওয়ার কথা নয়! কারণ, এমন ঘটনা মানেই পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেরই টু-পাইস কামাই করে নেওয়ার মওকা। সেখানে দু-একজন সাংবাদিক বা এলাকার রাজনৈতিক মাস্তান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জুটে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে জামালখানে কী ঘটেছে, আমরা হয়তো কখনোই জানতে পারব না, তবে আকাশে-বাতাসে ঠিকই ছড়িয়ে পড়বে—যেখানে টাকা কথা বলে, সেখানে এসব মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
দেশে ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা আছে, সেই আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, ইমারত কর্মকাণ্ডে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) বিধিতেও এভাবে ভবন নির্মাণ বা ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু গোটা শহরেই সেই আইন বা বিধিমালা লঙ্ঘন করা হয়। চউক সেসব দেখে না বা দেখতে চায় না।
একটা শহর কতটা অপরিকল্পিত ও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে, তা বুঝতে সিটি করপোরেশন, রাজউক বা চউকের মতো এসব কর্তৃপক্ষের অবহেলা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, অনিয়মের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায়। প্রতিটি ভবন তৈরিতে বা ভাঙতে বিভিন্ন পর্যায়ে কোনো না কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি থাকবেই।
গোটা প্রক্রিয়াকে জটিল করে রাখা হয় সে জন্য। ফলে নাগরিকেরাও সেই দুর্নীতি বা অনিয়মের সুযোগ নিতে বাধ্য হন। সেই বাধ্যবাধকতার মধ্যেও এভাবে ঘাপটি মেরে থাকে মৃত্যু। এ জন্য হয়তো আমরা নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যু দেখব, উন্নয়ন প্রকল্পের গার্ডারধসেও রক্তাক্ত হতে দেখব রাজপথ। কিন্তু অবহেলাজনিত এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকেই আমরা বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে দেখব না। একটা কল্যাণমূলক বা সভ্য রাষ্ট্র অধরাই থেকে যাবে, আমাদেরও তেমন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে ওঠা হবে না কোনো দিন। এমন হতভাগ্য নাগরিক আমরা।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী