একজন উচ্চপদস্থ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর’ (যুগ্ম সচিব) স্রেফ মৌখিক অভিযোগে একজন নারীকে তুলে আনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে (তর্ক সাপেক্ষে) সেই নারীর মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, এই সবগুলো বিষয় একত্র করলে যে কারও মনে হতে পারে ঘটনাগুলো কি আদৌ অন্তত কাগজে-কলমে দাবি করা রাষ্ট্রে (মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র নয়) ঘটছে? পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কথা বলছি, যা দেশে তুমুল আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে যা হয়, হতে পারত ঠিক সেটাই, একটা দায়সারা গোছের তদন্ত হবে, যার ফল কী হবে, জানেন এ দেশের সচেতন নাগরিকমাত্রই। কিন্তু হাইকোর্টের একটা নির্দেশ বিষয়টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। হাইকোর্ট স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সুলতানাকে আটকে অংশ নেওয়া র্যাব সদস্যদের অপসারণ করে বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে বদলি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পুরো ঘটনা তদন্তে নওগাঁর জেলা জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে অন্তর্ভুক্ত করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
সুলতানা জেসমিনের জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা দিয়ে শুরু করলেও এই কলাম লেখার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা তৈরি করেছিল লিমন। হ্যাঁ, র্যাবের গুলিতে পা হারিয়ে পঙ্গু হওয়া লিমন। লিমনের কেন এই কলামের অনুপ্রেরণা, সেটা নিয়ে বিস্তারিতভাবে কথা বলার আগে একটু দেখে আসা যাক র্যাবের সঙ্গে ঘটা একেবারে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার দিকে।
ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। একজন আসামিকে র্যাব সদস্যরা ধরে নিতে এলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে হই-হট্টগোল ও বাদানুবাদ হয়, যাতে র্যাব গুলি করে এবং অন্তত একজন মানুষ ঘটনাস্থলে নিহত হন। ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিকের সরেজমিন প্রতিবেদনের কিছু অংশ দেখে নেওয়া যাক।
‘অন্তত ১০ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার ভুক্তভোগীদের স্বজনেরা বলেছেন, গভীর রাতে সেলিমের বাড়িতে অস্ত্রসহ ‘অপরিচিত কয়েকজনের’ উপস্থিতি এবং হট্টগোলের কারণে প্রতিবেশীসহ আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসেন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্নেও গ্রেপ্তার করতে আসা ব্যক্তিরা তাঁদের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি। এতে স্থানীয় মানুষ ওই ব্যক্তিদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান। এরপর স্থানীয় লোকজন ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার করলে বরগাঁ গ্রামের আরও লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন নিজেদের র্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন অভিযানে যাওয়া ব্যক্তিরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, স্থানীয় লোকজন ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার শুরু করার পর র্যাব সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী আবুল কাশেম ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তিনি বাঁশের টুকরি বোনার কাজ করতেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় একজন মানুষের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও দেখেছেন, যেখানে র্যাবের সদস্যদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত একজন নারীর তর্কবিতর্কের কথা শোনা যায়, যেখানে সেই নারী ও র্যাব সদস্যরা আদৌ র্যাব নাকি ডাকাত, সেই প্রশ্নের বিতর্ক করছেন। তুলে নিতে আসা মানুষেরা যে র্যাব সদস্য, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রমাণ দেখতে চাইছিলেন তাঁরা। সুতরাং স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তার প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চয়ই আছে এই ভিডিওতে।
এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভালো তদন্ত হওয়া দূরে থাকুক, গ্রামের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এমনকি নিহত বৃদ্ধের ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মামলার পর। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত কি হবে? হলেও তাতে আদৌ কি কিছু পাওয়া যাবে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে লিমনকে নিয়ে ঘটা ঘটনার বর্তমান পরিস্থিতি জানলে। র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য অভিযোগ শুরু থেকে থাকলেও তাতে সামজের এক বৃহৎ অংশের সম্মতির কারণে সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য হচ্ছিল না প্রায়। লিমনের ক্ষেত্রে প্রথমে বেশ তীব্র জনপ্রতিক্রিয়া হয়, কারণ ঘটনার সময় লিমন ছিল নিতান্ত ১৬ বছরের কিশোর এবং ছিল নিরপরাধ। তাই প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর একটা পা হারানোতেই আমরা শোরগোল করি ভীষণ। তাই তাঁর মামলার ফলোআপ রিপোর্ট মাঝেমধ্যেই আসে আমাদের সামনে।
‘এক যুগেও পুলিশ জানে না লিমনকে কারা গুলি করেছিল’ শিরোনামে প্রথম আলো গত মাসেই একটা রিপোর্টে আমাদের জানিয়েছে কী ঘটেছে এই ঘটনার ক্ষেত্রে। রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘২০১১ সালের ২৩ মার্চ ১৬ বছরের কিশোর লিমন হোসেন র্যাবের অভিযানের সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এ ঘটনায় র্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা করেছিলেন লিমনের মা হেনোয়রা বেগম। লিমনকে কারা গুলি করেছিল, তদন্ত করে এখনো তা বের করতে পারেনি পুলিশ। এর ফলে মামলার বিচারকাজও শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় আছে লিমন ও তাঁর পরিবার।
লিমনের ঘটনা প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ কীভাবে এবং কাদের দ্বারা তদন্ত হতে হবে। এটা বুঝতে খুব চমৎকার একটি ধারণা দিতে পারে আমাদের আরেকটি আলোচিত ঘটনা।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরি করা একেবারে অনিবার্য। আইন তৈরি এবং সেই সংস্থা গঠন করার আগে পুলিশে হেফাজতে কিংবা পুলিশি অভিযানে গুরুতর আহত হওয়া অথবা মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে থাকতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার থাকা একটি বাহিনী একটি আধুনিক রাষ্ট্রে যাচ্ছেতাই করতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিরোধকল্পে ২০১৩ সালে প্রণীত আইনটিতে আজ পর্যন্ত একটিমাত্র মামলায় রায় হয়েছে। ২০১৪ সালে মিরপুরের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ভাইসহ তুলে আনা হয় ইশতিয়াক হোসেন জনিকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় তাঁর। মামলা হয় ওই আইনে এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বিচারিক আদালতে সেই মামলার রায় হয়, যাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুই সোর্সকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেন আদালত। ওই আইনে অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে কী ঘটনা ঘটে, সেটার খুব হালনাগাদ তথ্য নেই, কিন্তু বছর পাঁচেক আগে প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট এই আইন সম্পর্কে আমাদের খুব চমৎকার ধারণা দিয়েছিল।
‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন; তিন বছরে হেফাজতে মৃত্যু ২০৫, মামলা হাতে গোনা’ শিরোনামে সংবাদটিতে দেখা যায় এসব মৃত্যুর পরও মামলা করেন না ভুক্তভোগীরা আর করলেও যা হয়, সেটা নিয়ে রিপোর্টে আছে, ‘অভিযোগ আছে, সাহস করে মামলা করার পর নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তাঁর স্বজনেরা পরে চাপে পড়েন, মিটমাটের প্রস্তাব পান। অনেকে মামলা থেকে সরেও আসেন’। বলা বাহুল্য, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়, এমন ঘটনা শুধু হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রেই ঘটে এমনটা না, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনসহ আরও অন্য সব অপরাধের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটার কথা।
মিরপুরের ইশতিয়াকের ক্ষেত্রে মামলাটি তাঁর পরিবার সাহস করে চালিয়ে গেছে কিন্তু সেই মামলা কোনো ভিত্তির ওপর দাঁড়াতেই পারত না যদি সেটার বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হতো। পরিবারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার বিচার বিভাগের ওপরে ন্যস্ত হয়েছিল। সেই একই বিবেচনায় বলা যায় নওগাঁয় নিহত সুলতানা জেসমিনের ক্ষেত্রে একটা ভালো তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কারণ তাতে বিচার বিভাগ সংযুক্ত হয়েছে। তাহলে এই সমাজে এই প্রশ্নটা জোরেশোরে ওঠা উচিত পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পুলিশই কেন করবে? আমাদের কি পুলিশ বাহিনীর ওপর অগাধ আস্থা আছে? অগাধ আস্থা থাকলেও বা কী?
পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেটার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, কীভাবে নিতে হবে, সেটা নিয়ে অত্যন্ত আধুনিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটিতে সাংবিধানিকভাবে এমন আইন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, যেখানে পৃথক একটি সংস্থার মাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সংবিধানের ২০৬ (৬) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রাদেশিক কর্মকর্তার অভিযোগের ভিত্তিতে প্রদেশগুলোতে কর্মরত সব পুলিশ সদস্যের যেকোনো অসদাচরণ অথবা অপরাধের তদন্ত করবে স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ সংস্থা, যেটি তৈরি হবে একটি জাতীয় আইনের মাধ্যমে’।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেই দক্ষিণ আফ্রিকায় তৈরি হয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থা, ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট পুলিশ ইনভেস্টিগেটিভ ডিরেক্টরেট (আইপিআইডি)। দক্ষিণ আফ্রিকার গণতন্ত্রের মান এখনো খুব উন্নত পর্যায়ে যায়নি, তাই এই সংস্থাটির কার্যক্রম অনেকটা নিখুঁত হয়ে গেছে, সেই দাবি করা যাবে না। কিন্তু এটা দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তত নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে নিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত বাহিনী নিজে করতে পারে না। সেখানে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুলিশের মাধ্যমে, পুলিশের অভিযোগে তদন্তের চেয়ে বরং আইপিআইডির করা তদন্তের মান অনেক ভালো।
দেখা যাক, উন্নত, বিকশিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পরিস্থিতি কী। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে ২০০৪ সালে গঠিত হয়েছিল ইনডিপেনডেন্ট পুলিশ কমপ্লেইনটস কমিশন (আইপিসিসি)। এই সংস্থার বদলে ২০১৮ সালে গঠিত হয় ইনডিপেনডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কন্ডাক্ট (আইওপিসি)। এই সংস্থা পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের দেখভাল করে। বেশির ভাগ অভিযোগের তদন্ত এই সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী পুলিশ নিজেই করে। কিন্তু পুলিশের হেফাজতে, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা অবস্থায় কিংবা কোথাও পুলিশের গুলি বা বলপ্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিক মারা যাওয়া এবং গুরুতর আহত হওয়ার ক্ষেত্রে এই তদন্ত অবশ্যই আইওপিসি স্বতন্ত্রভাবে করবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ নিজে কোনোভাবেই কোনো রকম তদন্তের দায়িত্ব পাবে না। শুধু সেটাই নয়, পুলিশের ওপর ন্যস্ত তদন্তও চাইলে আইওপিসি নিজেই করতে পারবে।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরি করা একেবারে অনিবার্য। আইন তৈরি এবং সেই সংস্থা গঠন করার আগে পুলিশে হেফাজতে কিংবা পুলিশি অভিযানে গুরুতর আহত হওয়া অথবা মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে থাকতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার থাকা একটি বাহিনী একটি আধুনিক রাষ্ট্রে যাচ্ছেতাই করতে পারে না।
জাহেদ উর রহমান ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ–এর শিক্ষক