আমেরিকান অভিধান ‘মেরিয়াম-ওয়েবস্টার’-এর মতে, ‘মি টু’ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্যান্সেল কালচার বা বাতিলের সংস্কৃতির ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ে। এখানে বাতিল বলতে কোনো চুক্তি বা সম্পর্ক বাতিলের কথা বলা হয়।
স্টিভেন আরিগ কোহ তাঁর ‘ক্যান্সেল কালচার অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ক্যান্সেল কালচার বা বাতিলের সংস্কৃতি’ টার্মটি ২০১৬ সাল থেকে চালু হয়েছে। এই বাতিলের সংস্কৃতিকে তিনি একটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘বাতিলের সংস্কৃতি’ একটি পুরোনো বিষয়, অনেকটা ‘পাবলিক শেমিং’।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এর অতি আধুনিক মঞ্চমাত্র। সহজ ভাষায় বললে, কোনো ব্যক্তি বা দলের বিদ্বেষমূলক কথা বা আচরণের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তি বা দল তাদের বাতিল বা বয়কট করলে তাকে আমরা ‘বাতিলের সংস্কৃতি’র আওতায় আনতে পারি। তবে কাছাকাছি সময়ে আমরা উন্নত বিশ্বে উগ্র, বর্ণবাদী ও লিঙ্গবৈষম্যকারীদের বিরুদ্ধে এর প্রয়োগ বেশি দেখেছি। কিন্তু তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে আবার দেখেছি তার উল্টোটা।
বাতিলের সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ পুরোনো। ধারণা করা হয়, ধর্মীয় সংস্কার করার কারণে মিসরীয় ফারাও ‘আখেনআতেন’ প্রথম এ সংস্কৃতির শিকার হন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান আমলেও এর প্রবণতা ছিল উল্লেখ করার মতো। অনেক রোমান সম্রাটও এর শিকার হয়েছেন। এই দলে আছেন নিরো, ডমিশিয়ান ও কমোডিয়ুস।
আমেরিকার বিখ্যাত আইনজীবী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক এলান ডেয়ারশোভিৎসের একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘দ্য ক্যান্সেল কালচার: দ্য লেটেস্ট অ্যাটাক অন ফ্রি স্পিচ অ্যান্ড ডিউ প্রসেস’। তিনি তাঁর এই বইয়ে ক্যান্সেল কালচার বা বাতিলের সংস্কৃতিকে ‘নয়া ম্যাককার্থিবাদ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
(জোসেফ ম্যাককার্থি ছিলেন আমেরিকার উইসকনসিনের সিনেটর। এই সিনেটর তাঁর মেয়াদে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁর সেই সব কার্যক্রম তখন টিভিতেও প্রচার করা হতো। যদিও তাঁর সেই সব অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জীবন জোসেফ ম্যাককার্থি দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন)।
অধ্যাপক ডেয়ারশোভিৎসের মতে, উগ্র ডানপন্থী ম্যাককার্থিবাদ ও উগ্র বামপন্থী স্তালিনবাদই আধুনিক ‘বাতিল সংস্কৃতি’র পূর্বপুরুষ। এই গোটা প্রক্রিয়াই অবৈধ। যদিও ম্যাককার্থিবাদ ও স্তালিনবাদের ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে। আর বাতিলের সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে জনমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের হুমকি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
প্রশ্ন হলো, এই বাতিল সংস্কৃতি কীভাবে কাজ করে? প্রথমেই এটা কোনো সীমিত বা পরিমাপযোগ্য কার্যক্রম নয়। এমনকি এর ফলাফলের ভয়াবহতা বা ব্যাপকতাও আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন না। আর যেহেতু ইন্টারনেটই এই কার্যক্রমের মূল মাধ্যম, তাই কোনো কিছুই কার্যত এখান থেকে সরিয়ে ফেলা বা মুছে ফেলা যায় না।
সাজা বা দণ্ডের ফলাফল
বাতিলের সংস্কৃতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সবাই মিলে যে সাজা দেন, তা আসলেই কতটা ঠিক বা লঘু পাপে গুরু দণ্ড নাকি গুরু পাপে লঘু দণ্ড—এ বিচার করাও অসম্ভব।
কেউ সাজা পায়, আবার কেউ পায় না। কেউ দীর্ঘ মেয়াদে বাতিল বা বয়কটের শিকার হয়েছেন, কেউ স্বল্প মেয়াদে। যদিও অভিযোগের ধরন একই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই বাতিলের মেয়াদ ও প্রকটতা নির্ভর করে ব্যক্তির জনপ্রিয়তার ওপর।
কোনো ক্ষতিই পুষিয়ে দেওয়া যায় না। ধরুন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, ভাবধারা কিংবা বিশেষ কোনো লিঙ্গের মানুষের প্রতি বিদ্বেষমূলক, বৈষম্যমূলক, অপতথ্য কিংবা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তির অবশ্যই মানবিক ও সামাজিক ক্ষতি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বয়কট বা বাতিল করে দিলে কি তাঁর দ্বারা হয়ে যাওয়া ক্ষতি পূরণ করা যাবে? এই গোটা প্রক্রিয়ায় শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিই আলোচনায় থাকেন। কিন্তু যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির শিকার হয়, তার ভোগান্তি গৌণ হয়ে পড়ে।
জনগণের আদালত কতটা নির্ভুল? জনগণের আদালতের ‘কোর্ট অব ল’ বা বিচারিক আদালতের মতো কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, নীতি নেই; কিন্তু অসীম ক্ষমতা আছে। সেই আদালতে তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুশৃঙ্খল উপায় নেই। সেখানে সবাই মোড়ল। সবাই সবার চেয়ে বেশি বোঝা ও জানার দাবি জানাতে পারে। শুধু তা-ই নয়, খুব শক্তপোক্তভাবে মতামত প্রকাশ করেও বেশির ভাগ সময় মত প্রদানকারী দায় নিতে চান না। দায়সারা মন্তব্য ও দায়িত্বহীনতার ফলে সমাজে বিভক্তি বাড়ে।
একমুখী চিন্তা এবং বর্তমান সময়ের প্রয়োজনমতো ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা একটি ভয়ংকর প্রবণতা। এর সঙ্গে আছে নিজের মতো করে সত্য বানানোর বা বলার প্রবণতা। এ কাজ করতে গিয়ে নিজের অজান্তে কিংবা জেনেবুঝেই আমরা বহুদলীয় চিন্তার অন্তর্ভুক্তির যে প্রয়োজন, তা অস্বীকার করি।
ইংরেজিতে বহুদলীয় চিন্তার অন্তর্ভুক্তিকে বলা হয় ‘ইনক্লুসিভনেস’। এই ইনক্লুসিভনেস আদতে সাধারণ একটা শব্দ মনে হলেও এর তাৎপর্য মেলা। আর এর অনুপস্থিতিতে তীব্র সংকট তৈরি হতে পারে। এ সংকট ‘মানবতার ভিত্তি ও বৈচিত্রমূলক সংস্কৃতি’র শিকড়ে আঘাত করে। ফলে বিভিন্ন মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হয়। বিষয়টা আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ চলচ্চিত্রটি আমাদের আবার দেখা উচিত।
এই সংকট ও আঘাত কতটা আত্মঘাতী হতে পারে? এটা বোঝাতে অধ্যাপক ডেয়ারশোভিৎস তাঁর বইয়ে প্রচলিত একটি গল্প বলেছেন।
গল্পটা আমেরিকার কমিউনিস্ট-বিরোধিতার সময়ের। ঘটনা ম্যানহাটানের সিটি কলেজের। ছাত্ররাজনীতির জন্য কলেজের তখন অনেক নাম। তো একদিন কলেজের সামনে কমিউনিস্টদের বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। পুলিশ এল ছাত্রদের পেটাতে। এক পুলিশ তার লাঠি দিয়ে এক ছাত্রকে আঘাত করতে যাওয়ামাত্রই সেই ছাত্র বলে উঠল, ‘পুলিশ, পুলিশ আমাকে মেরো না। আমি অ্যান্টিকমিউনিস্ট।’ জবাবে পুলিশ বলল, ‘তুমি কোন ধরনের কমিউনিস্ট, সেটা জেনে আমার কোনো কাজ নেই।’ বলেই বেদম মার।
মানে কমিউনিজম শব্দটাই তখন এতটা অভিযুক্ত ছিল যে এই সামান্য শব্দ দিয়ে যে কাউকে তখন বাতিল করা, মুছে দেওয়া, এমনকি ধ্বংস করে দেওয়া যেত।
আমেরিকান সমাজে ঘটে যাওয়া সেসব অনাচার কি আমাদের সমাজে নতুন চেহারা নিয়ে ধরা দিচ্ছে না?
উইনস্টন চার্চিল একসময় বলেছিলেন, মিথ্যা তার জুতার ভেতর সত্যকে পুরে দুনিয়া চষে বেড়ায়। সেই ছিল ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগের কথা। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে সত্য তো জুতা পরারই সুযোগ পাচ্ছে না। তাই পাঠককে মনে করিয়ে দেব, সমাজবিদ ডানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহানের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘মতামত নিজস্ব হতেই পারে, কিন্তু সত্য নিজস্ব হতে পারে না।’
রিনভী তুষার লেখক ও গবেষক